নিউজ ডেস্ক: ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই কোণঠাসা তৎকালীন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। বিগত সরকারের নানা অপকর্মের পরোক্ষ সহায়তাকারীর অভিযোগ উঠেছে দলটির বিরুদ্ধে। দাবি উঠেছে জাতীয় পার্টিকে দল হিসেবে নিষিদ্ধের। এমন পরিস্থিতিতে বড্ড বেকায়দায় জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।
অন্যদিকে রাজনীতিতে দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটির শীর্ষ নেতারা নিয়মিতভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে ঈদের আগে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের রংপুরের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। দলটির অভিযোগ এ ঘটনায় মামলা নিতে গড়িমসি করছে পুলিশ। প্রতিবাদে রংপুরে বিক্ষোভ করেছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। দোষীদের গ্রেপ্তারে দেয়া হয় ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চাইছে জাতীয় পার্টির বিচার ও বহিষ্কার। আর এনসিপি’র নেতাকর্মীদের ‘কুলাঙ্গার’ সম্বোধন করে বক্তব্য দিয়েছেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। এদিকে বরিশাল ও লালমনিরহাট জাতীয় পার্টি অফিস ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
দীর্ঘদিনের আলোচনার মধ্যেই নতুন করে সামনে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের রংপুরের বাড়িতে হামলার ঘটনায়। রংপুরের সেনপাড়ায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বাসা ‘দ্য স্কাই ভিউ’তে হামলা, ভাঙচুর ও মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। জাতীয় পার্টি হামলার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের দায়ী করে। এদিন রাত ৯টার দিকে রংপুর প্রেস ক্লাব চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি সেখান থেকে সেনপাড়া পর্যন্ত যায়। এ সময় তারা জাতীয় পার্টির বিগত সরকার আমলের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে নেতাদের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধরা বাসায় হামলা চালায়। এ সময় বাসায় ছিলেন জিএম কাদের।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জিএম কাদের বলেন, এদেশে এখন কেউ নিরাপদ নয়। আমি বিশ্রাম করছিলাম। নেতাকর্মীরা চলে যাওয়ার পর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা-ভাঙচুর করে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান, সাবেক রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বৈষম্য বিরোধীরা আন্দোলনের ব্যানারে এই সশস্ত্র হামলা হয় বলে জানান। তিনি এর জবাব দেয়ারও ঘোষণা দেন।
জাতীয় পার্টির দাবিকে নাকচ করে এনসিপি’র সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রংপুর সফরের প্রতিবাদে তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাদের বিক্ষোভে হামলা করেছেন জাপার স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন এনসিপি’র শীর্ষ দুই নেতা। জাতীয় পার্টিকে ‘গণতন্ত্রের সঙ্গে দীর্ঘ প্রতারণা’ করার অভিযোগে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান সদস্য সচিব আখতার হোসেন। এক দলীয় সভায় তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ধরে ‘ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য গৃহপালিত বিরোধী দলের’ ভূমিকা পালন করে এসেছে। প্রতারণার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ আর সম্পর্ক রাখবে না। আমরা লক্ষ্য করছি, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি পাতানো নির্বাচনে প্রতারণামূলক অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করায় জাতীয় পার্টিকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় পার্টি আজও জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেনি। তাদের ভেতরে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধ নেই। যারা স্বেচ্ছায় এখনো জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে নাই, তাদেরকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলার কোনো মানে হয় না। জাতীয় পার্টি হোক বা আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ধ্বংসের দায়ে সবাইকেই জনগণের সামনে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এনসিপি’র মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম তার ভেরিফাইড ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে লেখেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দোসর। বিরোধী দলের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করে আওয়ামী লীগকে সরকারি দলের বৈধতা দিয়েছিল এই জাতীয় পার্টি। প্রত্যেক ইলেকশনের আগে অবৈধ সরকারি দলের বিরোধিতার নামে ভণ্ডামি করতো। তারপর নির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন আগে জিএম কাদের ভারতে গিয়ে নেগোসিয়েশন করে ডামি বিরোধী দল সেজে বসে থাকতো।
তিনি আরও বলেন, সেই জিএম কাদের এখনো বাইরে কীভাবে? সরকারকে ধাক্কা না দিলে কি কাজ হয় না? নাকি প্রত্যেকটা কাজের জন্য ছাত্র-জনতাকে নতুন করে মাঠে নামতে হবে?
কথার লড়াইয়ে দমে নেই জাতীয় পার্টিও। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রতিক্রিয়া বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তিনি জিএম কাদেরের বাসভবনে হামলার প্রতিবাদ জানান। শুক্রবার জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইলে প্রতিবাদ সভায় তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, দেশের মানুষ নিজের ঘরে নিরাপদে থাকতে পারবে না? একটি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে এমন একটি অনিরাপদ দেশের জন্য কি আমাদের সন্তানরা জীবন দিয়েছিল? এই বিক্ষোভ সমাবেশে নেতাকর্মীরা এনসিপিকে নিয়ে নানান বিরূপ মন্তব্য করেন।
শনিবার জিএম কাদেরের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবাদে রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এ সময় কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনে রংপুরে ছাত্রদের পাশে শুরু থেকে দাঁড়িয়েছিল জাতীয় পার্টি। আন্দোলনের সময় সক্রিয়ভাবে ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান ছিল জাতীয় পার্টির। আর সেই জাতীয় পার্টিকে দেশের রাজনীতি থেকে আজ মাইনাস করার পাঁয়তারা চলছে। এ সময় তিনি এনসিপি’র নেতাকর্মীদের ‘কুলাঙ্গার’ বলে সম্বোধন করেন।
এর আগে, শুক্রবার রাতে জিএম কাদেরের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতিসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনকে অভিযুক্ত করে রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সমাজের সদস্য সচিব আরিফ আলী। তিনি বলেন, জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বাড়িতে হামলার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, এনসিপি ছাড়াও অনেক সন্ত্রাসীরা সম্পৃক্ত ছিল। পরিকল্পিতভাবে চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমান বলেন, একটি এজাহার আমরা গ্রহণ করেছি। সরজমিন তদন্ত করে যারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে শনিবার রাতে বরিশাল ও লালমনিরহাট জেলা জাতীয় পার্টি অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। রাতেই রংপুরে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে এনসিপি-বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। অরাজক পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ করে সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থানে দেখা যায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে সারজিস আলম বলেন, জাতীয় পার্টির আন্দোলনের আড়ালে আওয়ামী লীগ রাস্তায় নামলে তা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বিপজ্জনক। জিএম কাদের রংপুরে এসে অবৈধ নির্বাচনে বিজয়ী মেয়রকে স্বপদে বসানোর জন্য মিটিং করেছে। এটি জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার প্রক্রিয়া। এখনকার ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন এটা মেনে নিতে পারিনি। তারা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা মিছিলে হামলা করেছে। এসব ফুটেজ রয়েছে। পরবর্তীতে তাদের কেউ নিজেদের রক্ষার জন্য জিএম কাদেরের বাসায় হামলা করেছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।