নিউজ ডেস্ক: রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে আলোচিত সন্ত্রাসী হামলা মামলায় বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে সাতজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর দেওয়া সেই রায়ের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ১৭ জুন সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে ।
কেন আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, ২২৯ পৃষ্ঠার রায়ে সেটি উল্লেখ করেছেন উচ্চ আদালত।
বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আসামিদের আপিল ও জেল আপিল এবং ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) খারিজ করে ওই রায় দিয়েছিলেন।
আদালত রায়টি বাংলায় ঘোষণা করেন। রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। রায়ে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি সহিদুল করিম।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নির্মল কুমার দাস, সৈয়দা শবনম মুস্তারী ও মো. তারিকুল ইসলাম হিরা।
আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আমিমুল এহসান, মো. মাহিনুর রহমান ও আরিফুল ইসলাম। আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন এস এম শফিকুল ইসলাম।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালায় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতী) সদস্যরা। দেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস এ হামলায় ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানি, এক ভারতীয়, এক বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশিসহ মোট ২০ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে প্রাণ হারান বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন আহমেদ ও সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম।
হামলার পর জিম্মি সংকটের অবসানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি। তারা হলেন- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় নিহত হয়েছেন নব্য জেএমবির আরও ৮ সদস্য। তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজা করিমও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।
এ ঘটনার মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান একজনকে খালাস দিয়ে সাতজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ। খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
পরে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। আর কারাবন্দি আসামিরা আপিল করেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ‘অপরাধ ও দণ্ড’ সংক্রান্ত ৬ (১) (ক) (অ) (আ) এবং ৬ (২) (অ) (আ) ধারা উল্লেখ করেন।
৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশি নাগরিক-(ক) বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোনো সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে- (অ) অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে; অথবা (আ) অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর জখম, আটক বা অপহরণ করার জন্য অপর কোনো ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে।
৬ এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা বিদেশি নাগরিক উপ-ধারা (১) এর দফা (ক) এর- (অ) উপ-দফা (অ) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে;
(আ) উপ-দফা (আ) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন তাহলে ওই অপরাধের নির্ধারিত শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয় সেক্ষেত্রে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর ও অন্যূন ৪ (চার) বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন;
রায়ে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার বক্তব্য পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে আদালত বলেন, কেউ যদি (অ) উপদফা অনুসারে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা গ্রহণ করেন, সে ক্ষেত্রে ৬(২)(অ) মতে সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে।
মামলাটিতে দেখা যায়, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল এবং শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ঘটনাস্থলে হামলায় সরাসরি অংশ নিয়ে নিরীহ নিরস্ত্র অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে পূর্ব পরিকল্পনা মতে জিম্মি করে। তারা আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য এবং ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে ১৭ জন বিদেশি, ৩ জন দেশি এবং গ্রেনেড হামলা করে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ফলে আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে পাঁচজন সন্ত্রাসী অপরাধী। স্বীকৃত মতে, এই পাঁচজন সন্ত্রাসী ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে কেউ যদি বেঁচে থাকত তাহলে এ আইনের অধীন বিচার শেষে তাকে ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ৬(২) (অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত।
আদালত আরও বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুসারে কেউ যদি ওই অপরাধের সহায়তা বা প্ররোচিত করে কোনো অপরাধ সংঘটন করেন এবং ওই অপরাধের শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, সেক্ষেত্রে আইনে ৬(২)(আ) তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১৪ (চৌদ্দ) বছর ও অন্যূন ৪ (চার) বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এটা স্বীকৃত যে ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে ঘটনাটি ঘটানোর উদ্দেশ্যে এই আপিলকারীদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না কিংবা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ঘটনাটি ঘটানোর জন্য কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেননি। ফলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অভিযোগ এই আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এখানে ৬(১)(ক)(অ) এবং আ উপ-দফায় উল্লিখিত অপরাধ দুটি পৃথক অপরাধ।
রায়ে আরও বলা হয়, মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে রজু হওয়া, অভিযোগপত্র দাখিল করা, অভিযোগ গঠন এবং বিচার শেষে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচার শেষ হওয়ায় এখানে পেনাল কোডের বিধান প্রয়োগের সুযোগ নেই। বিচারিক একই অভিপ্রায় উল্লেখ করে (কমন ইনটেনশন) আপিলকারীদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আইনের ৬(২) (অ) ধারার বর্ণিত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক নয় বলে আমরা মনে করি।
‘আপিলকারী আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করা, নিহত পাঁচ সন্ত্রাসীকে বাছাই, নিয়োগ এবং তাদের দীর্ঘদিন গোপন স্থানে রেখে শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করার কারণে ওই পাঁচ সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আপিলকারী আসামিদের অপরাধের ক্ষেত্রে ৬(১)(ক)(আ) ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে বলে আমরা মনে করি। ’
আদালত বলেন, আপিলকারীদের আইনজীবী আসামিদের বেকসুর খালাস প্রার্থনা করেন। যদি ‘আ’ ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয় সে ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০ বছর কারাবাসের প্রার্থনা করেন। অপরদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মৃত্যুদণ্ড শ্রেয় ছিল বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু ‘আ’ ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হিসেবে আমৃত্যু কারাদণ্ড হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
রায়ে সব কিছু বিবেচনা করে আদালত বলেন, আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আইনের ৬(২)(আ) ধারায় বর্ণিত শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। এ ক্ষেত্রে আলোচ্য হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা, নৃশংসতা, ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে সন্ত্রাসীদের সামগ্রিক নিষ্ঠুর আচরণ এবং এ ঘটনার ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া বিবেচনায় নিয়ে আপিলকারী আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেককে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে বলে আমরা মনে করি।
রায়ের আদেশ অংশে বলা হয়, ডেথ রেফারেন্স রিজেক্ট করা হলো। আপিলকারী আসামিদের ধারা ৬ (২) (অ) অনুসারে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ ও রহিত করে ৬(২)(আ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।