নিউজ ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের সামরিক সংঘাত শেষ হয়েছে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে। তবে কূটনৈতিক আবরণে ঢাকা এই যুদ্ধবিরতি আসলে নতুন করে উসকে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো এবং এর নেতৃত্বদানকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র যে কৌশল নিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-বিশ্ব রাজনীতি ধীরে ধীরে অস্ত্রনির্ভর এক পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পরপরই জার্মানিতে অনুষ্ঠিত সামরিক জোট ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে ওয়াশিংটন জোর দিয়ে বলেছে-ন্যাটো সদস্যদের সামরিক ব্যয় ন্যূনতম ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এর ফলে ইউরোপের অস্ত্র-নির্ভরতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে বার্লিনভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. হান্না গ্লোবারম্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একদিকে নিজের অস্ত্রশিল্প টিকিয়ে রাখছে, অন্যদিকে ইউরোপকে রাশিয়ার আতঙ্কে রেখে নিজের অস্ত্র বাজার সমৃদ্ধ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত সেই যুক্তিকে আরও পোক্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ২০২৬ সালের জন্য প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে-যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশটির সর্বোচ্চ সামরিক ব্যয়।’
এদিকে, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে ইসরায়েলের রণকৌশলে। শত্রুদেশের ছোঁড়া যেকোন সুপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শতভাগ সফলভাবে প্রতিহত করার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ করতে চাইবে তেলআবিব সরকার।
ইরান ১২ দিনে ইসরায়েলে প্রায় ৫৯১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। এর মধ্যে ৫০টি সরাসরি আঘাত হানে দেশটিতে। ইসরায়েল তার ‘আয়রন ডোম’, ‘ডেভিড’স স্লিং’ এবং ‘এরো-৩’ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৯৫ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাকি ৫ শতাংশের সরাসরি আঘাত ইসরায়েলকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইয়োহান তামির বলেন,‘ইসরায়েলের লক্ষ্য এখন একটাই- আকাশসীমার প্রতিরক্ষা শতভাগে উন্নীত করা। এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, প্রতিটি অসম্ভবকেও সম্ভব করা এখন সময়ের দাবি। ইসরায়েল চাইছে তার আক্রমণাত্মক শক্তিও আরও বাড়াতে।’
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ আরও জানান, নেতানিয়াহুর সরকার নতুন ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন স্কোয়াড্রন এবং সাইবার আক্রমণ প্রযুক্তি আরো শানিয়ে নিতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে, পরমাণু শক্তিধর বেপোরোয়া ইসরায়েলকে যথাযথ জবাব দিতে 'নিউক্লিয়ার ডেটারেন্স’কে একমাত্র কার্যকর উপায় মনে করবে তেহরান। যুদ্ধে একাধিক জেনারেল ও পরমাণু বিজ্ঞানীর প্রাণহানি এবং পরমাণু স্থাপনায় হামলার পর ইরান তার প্রতিরক্ষা কৌশল ঢেলে সাজাবে। এর অংশ হিসেবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফর করেছেন, যেখানে রাশিয়ার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত।
তেহরানের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলী রেজা শিরাজী বলেন, ‘এই যুদ্ধ ইরানকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে-ডেটারেন্স ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। এখন যদি তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির করেও ফেলে, তাতে বিশ্ববাসীর অবাক হবার কিছু থাকবে না। রাশিয়ার দেয়া পুরোনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে তেহরান চাইবে অত্যাধুনিক এস-৪০০ বা চীনের এইচকিউ-২২ সিস্টেম। পাশাপাশি, পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার বাসনাও আরও তীব্র হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র আর কিছু ড্রোন দিয়েই হুংকার দিয়েছে তেহরান। পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের ভেলকি দেখাতে পারেনি।’
সিপ্রি (স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট)-এর বিশ্লেষক মারিয়া হাভেল বলেন, ‘ইরান হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে বলবে না যে তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চাইছে, কিন্তু পর্দার আড়ালে তারা এখন ডেটারেন্স সক্ষমতা গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগে যাবে।’
অস্ত্র প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটছে কারা: বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র- বিশ্বের মোট অস্ত্র রপ্তানির ৪১ শতাংশ, রাশিয়া ১৬ শতাংশ এবং চীন প্রায় ৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এই তিন দেশই ইরান-ইসরায়েল সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে পুঁজি রেখে বিশ্বের অস্ত্র বাজারে সর্বোচ্চ প্রভাব ধরে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতির বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু ব্ল্যাকওয়েল বলেন,‘প্রতিটি সীমিত যুদ্ধ আমেরিকার অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অলিখিত ‘বোনাস সিজন’। রেথন, লকহেড, বোয়িং-সব গুলোই নতুন নতুন অর্ডারে ভাসছে।’
সমরাস্ত্রই কী তবে টিকে থাকা এবং বিশ্বশান্তির একমাত্র কার্যকর মাধ্যম হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে অনেকের মনে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু প্রতিটি দেশ এখন আগের চেয়ে বেশি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পারমাণবিক বা প্রচলিত- উভয় অস্ত্রই এখন রাজনৈতিক কৌশল ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। শান্তির পেছনে সমরাস্ত্রের ছায়া যত গভীর হচ্ছে, ততই নতুন এক বৈশ্বিক ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে-যেখানে জয়ী হয় অস্ত্র প্রস্তুতকারীরা, আর ক্ষতবিক্ষত হয় মানবতা, বিপর্যস্ত হয় বেসামরিক মানুষ, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি।