নিউজ ডেস্ক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের বর্ষপূর্তি উদযাপন ও দেশের নতুন ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির আশায় গত সপ্তাহে ঢাকায় জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে মানুষ কনসার্ট, সমাবেশ ও বিশেষ দোয়া মাহফিলে অংশ নেন। অনেকে শেখ হাসিনার এই পতনকে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আখ্যা দেন। কিন্তু এই আনন্দমুখর দৃশ্য গত ১২ মাসের পুরো গল্প নয়।
অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, এই সময়ে গণপিটুনিতে হত্যা, মব বা সংঘবদ্ধ জনতার সহিংসতা, প্রতিশোধমূলক হামলা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থান ঘটেছে।
অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের মানুষের ওপর দমনপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এ ছাড়া তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে দেশে ফেরত আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
নারী অধিকারকর্মী শিরিন হক বিবিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, বিপ্লব নয়। নারীবিদ্বেষ আগের মতোই আছে।’ তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ছিলেন। গত এপ্রিলে এই কমিশন লিঙ্গসমতা নিশ্চিত, নারীদের উত্তরাধিকার ও বিয়েবিচ্ছেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়।
পরের মাসে হাজার হাজার কট্টরপন্থি প্রস্তাবিত সুপারিশের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে বিক্ষোভকারীরা এই কমিশন ভেঙে দেওয়ার দাবি জানায়। পরবর্তীতে কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো প্রকাশ্য আলোচনা হয়নি।
শিরিন হক বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম যখন আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন চালাচ্ছিল, তখন অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের যথেষ্ট সমর্থন না করায় আমি হতাশ হয়েছি।’ অভিযোগের বিষয়ে বিবিসি মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করলেও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সাড়া দেয়নি।
শুধু নারীরা নয়, গত বছর কট্টরপন্থিরা সুফি মুসলিমদের অসংখ্য মাজার ভাঙচুর করেছে। শিরিন হকের মতো অনেকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, বাংলাদেশ এখনও অতীতের মুখোমুখি।
দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী কেবল জবাবদিহিতা নয়, প্রতিশোধও দেখতে চেয়েছিল। আওয়ামী আমলে যে অবিচার ছিল, তা অনুকরণ করা এখন চলতে পারে না।
যদিও আওয়ামী লীগের দাবি, গত এক বছরে তাদের কয়েকশ সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম গণবিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি স্বীকার করেন, ‘একটি বড় আন্দোলনের পর স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে সময় লাগে। আমরা এখন পরিবর্তনের পর্যায়ে আছি।’ ইসলামপন্থি প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নাহিদ বলেন, এটি বহু বছরের পুরোনো সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অংশ।
তবে ইতিবাচক দিকও আছে। অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি স্থিতিশীল রেখেছে। আশঙ্কার বিপরীতে ব্যাংক খাত টিকে গেছে। বাংলাদেশ ঋণ শোধ করেছে, খাদ্যের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল রেখেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার বজায় রেখেছে।
এদিকে নির্বাসিত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী আরাফাত বিবিসিকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছরে জনতার সহিংসতা বেড়েছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশের জন্য আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। অনেকে বলছেন, যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থবহ পরিবর্তন না আসে, তবে আন্দোলনে নিহতদের ত্যাগ অর্থহীন হয়ে যাবে।