আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ● ২৯ কার্তিক ১৪৩২
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১৩ নভেম্বর ২০২৫
হাসিনার উল্টো সুর, এখন বলছেন—‘উৎখাতের পেছনে আমেরিকার হাত নেই’

হাসিনার উল্টো সুর, এখন বলছেন—‘উৎখাতের পেছনে আমেরিকার হাত নেই’

ভারতকে খুশি করতে বারবার অস্ত্র উদ্ধার নাটক হাসিনার

ভারতকে খুশি করতে বারবার অস্ত্র উদ্ধার নাটক হাসিনার

অভ্যুত্থানের সপক্ষের দলগুলো ঐক্যবদ্ধ না থাকলে মহাবিপদ: ড. ইউনূস

অভ্যুত্থানের সপক্ষের দলগুলো ঐক্যবদ্ধ না থাকলে মহাবিপদ: ড. ইউনূস

জাতীয় ঈদগাহের সামনে ড্রামভর্তি খণ্ডিত মরদেহের পরিচয় মিলেছে

জাতীয় ঈদগাহের সামনে ড্রামভর্তি খণ্ডিত মরদেহের পরিচয় মিলেছে

ভারতকে খুশি করতে বারবার অস্ত্র উদ্ধার নাটক হাসিনার

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, রাত ০৯:৩৪

Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন আমলে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বারবার মঞ্চস্থ হয়েছিল অস্ত্র উদ্ধার নাটক। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন চুনারুঘাটে ২৪৩ হেক্টরের এ বনে র‌্যাবের উদ্যোগে মোট ৯ দফা অভিযান চালানো হয়। দেশে যখনই রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতো, তখনই জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতে সাজানো হতো অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা। উদ্ধার দেখানো হতো ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এগুলো ঠিক কোথা থেকে, কী উদ্দেশ্যে, কারা এনেছিলেন—এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। উদ্ধার দেখানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এসব ঘটনায় চুনারুঘাট থানায় অন্তত ১০টি মামলা করা হলেও একটিরও রহস্য উদঘাটন হয়নি। এতেই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি এ উদ্যান থেকে অস্ত্র উদ্ধার ছিল আওয়ামী সরকারের পরিকল্পিত নাটক?

সচেতন মহল মনে করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কৃপা ও আশীর্বাদ পেতেই দেখানো হতো সীমান্তের জঙ্গলে বিপুল অস্ত্রভান্ডারের সন্ধান। কেউ কেউ মনে করেন, ক্রসফায়ার ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুমের ঘটনায় র‌্যাবের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সাজানো হয়েছিল এ অস্ত্র উদ্ধারের নাটক।

এসব প্রশ্ন প্রথমবার অস্ত্র উদ্ধারের পরই জোরালো হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। বিশেষ করে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয় এবং নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের সাত খুনের ঘটনার পর দুদফা অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে তখনই নানা প্রশ্ন উঠেছিল।

২০১৪ সালে বিবিসি বাংলার একটি সংলাপে তৎকালীন উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)-এর নির্বাহী পরিচালক ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ভারতের নতুন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অস্ত্র উদ্ধার ঘটনার অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন। সে সময় তিনি র‌্যাবের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছিলেন, সময়ের কারণেই প্রশ্ন উঠছে। যখন শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলছে আবার হবিগঞ্জে অস্ত্র উদ্ধার করছে। এটা একটা প্রশ্ন থেকে যায়। পাশাপাশি মোদি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের একটা ইচ্ছা সরকারের রয়েছে।

একই সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের তৎকালীন উপদেষ্টা ও টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি আহমেদ আজম খান র‌্যাবের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য অস্ত্র উদ্ধারের নামে নাটক সাজানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ১৬ মে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ভারতের লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। এর আগে ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব সাতজনকে অপহরণ ও লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ২৬ মে মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের ঠিক ছয়দিন পরই সাতছড়ি উদ্যান থেকে অস্ত্র উদ্ধার দেখায় র‌্যাব। এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কর্নেল জিয়াউল আহসান। যিনি শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।

সর্বশেষ আওয়ামী লীগের পতনের পর ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৬ আগস্ট দেশ থেকে পালানোর সময় মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে ঢাকা কলেজের সামনে ছাত্র ও হকার নিহতের মামলায় ইন্ধনদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে রয়েছেন।

আয়নাঘরের জনক, গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড, ফোনকলে আড়িপাতা, মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ডের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন জিয়াউল আহসান।

সাতছড়িতে যতবার অস্ত্র উদ্ধার

২০১৪ সালের ৩ জুন থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দফায় অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে ৩৩৪টি কামান বিধ্বংসী রকেট, ২৯৬টি রকেট চার্জার, একটি রকেট লঞ্চার, ১৬টি মেশিনগান, একটি বেটাগান, ছয়টি এসএলআর, একটি অটো রাইফেল, পাঁচটি মেশিনগানের অতিরিক্ত খালি ব্যারেল, প্রায় ১৬ হাজার রাউন্ড বুলেটসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধারের দাবি করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

এরপর ওই বছরের ১৬ অক্টোবর চতুর্থ দফায় উদ্যানের ভেতরে মাটি খুঁড়ে তিনটি মেশিনগান, চারটি ব্যারেল, আটটি ম্যাগাজিন, ২৫০ গুলির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আটটি বেল্ট ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রেডিও উদ্ধার দেখানো হয়। পরে ১৭ অক্টোবর দুপুরে এসএমজি ও এলএমজির আট হাজার ৩৬০ রাউন্ড, থ্রিনট থ্রি রাইফেলের ১৫২ রাউন্ড, পিস্তলের ৫১৭ রাউন্ড, মেশিনগানের ৪২৫ রাউন্ডসহ মোট ৯ হাজার ৪৫৪ রাউন্ড বুলেট উদ্ধার দেখায় র‌্যাব।

পঞ্চম দফায় ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সাতছড়িতে অভিযান পরিচালনা করে ১০টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৪০ এমএম অ্যান্টিট্যাংক রকেট উদ্ধার হয়।

ষষ্ঠ দফায় ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে ১৩টি রকেট লঞ্চারের শেলসহ বেশকিছু বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ২ মার্চ বিজিবি বিশেষ অভিযান চালিয়ে উদ্যান থেকে ১৮টি ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট লঞ্চার উদ্ধার করে। একই বছরের ১৩ আগস্ট সাতছড়ি এলাকায় মাটির নিচ থেকে পলিথিন মোড়ানো অবস্থায় ৯টি একনলা বন্দুক, তিনটি পিস্তল ও ১৯ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধারের কথা জানান বিজিবি।

২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে খাগড়াছড়ির বাসিন্দা এবং ভারতীয় নাগরিক আবেল ত্রিপুরাকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাতছড়ির গহিন বনে অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সদস্যরা। অভিযানে ১৫টি রকেট প্রফেল গ্রেনেড (আরপিজি), ২৫টি বোস্টার, ৫১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের কথা বলা হয় তখন।

এসব ঘটনায় চুনারুঘাট থানায় অন্তত দশটি মামলা দায়ের করা হলেও একটি ঘটনারও রহস্য উদঘাটন হয়নি। প্রথমবার অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ২০১৪ সালের ৪ জুন চুনারুঘাট থানায় মামলা রুজু করা হয়। প্রথমে থানা পুলিশের কাছে তদন্তে থাকলেও পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তৎকালীন হবিগঞ্জ সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বসু দত্ত চাকমা। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে এসব অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ত্রিপুরা পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (টিপিডিএফ) কর্তৃক ২০ থেকে ২৫ বছর আগে এখানে মজুত করে রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করে তদন্ত নিষ্পত্তি করেন। একই সঙ্গে এসব অস্ত্র মজুতের বিষয়ে কোনো আসামি পাওয়া না যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে মামলা পুনরুজ্জীবিত করার কথা উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ মামলায় আবেল ত্রিপুরাকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশের খাগড়াছড়িতে বসবাস করেছিলেন তিনি। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলা হলেও রহস্য উদঘাটন হয়নি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক চম্পক দাম চার্জশিটে উল্লেখ করেন, আসামি আবেল ত্রিপুরা ঘটনাস্থলে অস্ত্র মজুত করার কথা জানায়। কিন্তু অস্ত্রের উৎস ও মজুতের কারণ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেও প্রকাশ না করায় কারণ জানা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অস্ত্র উদ্ধারের খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু স্থানীয় কোনো সাংবাদিককে তারা অভিযানস্থলের আশপাশেও যেতে দেয়নি। প্রতিটি অভিযানে তারা ঢাকা থেকে নির্দিষ্ট সাংবাদিক নিয়ে আসতেন। অস্ত্র উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে আসা ঢাকার সাংবাদিকরা তাদের মতো করে এ উদ্ধার নাটকের বয়ান তৈরি করে প্রচার করতেন।

চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি অক্টোবরে এ থানায় যোগদান করেছি। সাতছড়িতে অস্ত্র উদ্ধার যেহেতু দীর্ঘদিন আগের। তাই এ সম্পর্কে আমি অবগত নই। মামলাগুলোর কী অগ্রগতি আছে খোঁজ নিয়ে জানাব।

হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার এএনএস সাজেদুর রহমান বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ঘটনার চলমান কোনো মামলা পাইনি। তবে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, এজন্য সাতছড়িতে আমাদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে।

মন্তব্য করুন


Link copied