আর্কাইভ  রবিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ● ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০২৫
হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে

হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে

হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রায় ২৭ নভেম্বর

প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি
হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রায় ২৭ নভেম্বর

হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের মামলার যুক্তিতর্ক ২৫ নভেম্বর

হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের মামলার যুক্তিতর্ক ২৫ নভেম্বর

রাজনীতি ছেড়ে 'পাপমুক্ত' হতে দুধ দিয়ে গোসল!

রাজনীতি ছেড়ে 'পাপমুক্ত' হতে দুধ দিয়ে গোসল!

জলবায়ু পরিবর্তন: নারীর জীবনে সংকট ও সংগ্রাম

রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, দুপুর ০৩:৩৬

Advertisement

পারভীন ইসলাম : বর্তমানে বহুল আলোচিত এবং পৃথিবীর জুড়ে উদ্বেগের বিভিন্ন বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এ বিশাল সৌরমণ্ডলে বাসযোগ্য গ্রহটি আজ জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে হুমকির সম্মুখীন।

প্রাকৃতিক কারণে স্বাভাবিকভাবেই জলবায়ুতে কিছু পরিবর্তন হয়, যে পরিবর্তনগুলো প্রাকৃতিকভাবেই রিপেয়ার হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভোগবাদী মানসিকতা, অতিরিক্ত শিল্পায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং দূষণ থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করার আন্তরিক সচেতনতার অভাব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী।

এটা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ১৯৭২ সালের স্টকহোম কনভেনশনে বিশ্ব পরিবেশ অবক্ষয় ও প্রাণীকুল বিশেষ করে মানুষের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এই ঘোষণার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ‘নারীর সঙ্গে পরিবেশ’। এর সঙ্গে আরও যুক্ত ছিল পরিবেশ উন্নয়ন। এবং উন্নয়নের প্রধান শর্ত হল জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ।

বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং আর্থসামাজিক অবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের ফলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে সুপেয় পানির উৎস কমতে শুরু করেছে। প্রকট হচ্ছে বর্জ্য সমস্যা। 

 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারী ও শিশু পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তারা নিরাপত্তা সুযোগ সুবিধা প্রাপ্যতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়, তা দূর করার জন্য আন্দোলনমুখী কর্মসূচি প্রয়োজন।

আমরা জানি পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম শিকার হচ্ছে নারী এবং শিশু। যেহেতু বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে, সেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ‘পরিবেশ উপ-পরিষদ’ নামে স্বতন্ত্র উপ-পরিষদ গঠন করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ, আবহাওয়া পরিবর্তনের মতো সব সময় ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান, এমন নয়। নারীর ওপর রয়েছে এর বহুমুখী প্রভাব। প্রাকৃতিক জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, আইলায় ঘরবাড়ি হারা মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে আসা নারীদের অবস্থা খুব ই নাজুক থাকে। আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের জন্য গোসল এবং টয়লেট ব্যবস্থা হাকে না ফলে দিনের পরদিন তাদের স্নান এবং টয়লেট এর জন্য রাতের অন্ধকারের উপর নির্ভর করতে হয়। আশ্রয় কেন্দ্রে যৌন হয়রানির শিকার হয় কন্যা শিশু আর নারীরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পুরুষের চেয়ে নারীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে উপকূল, হাওর অঞ্চলের নারীরা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হন। উপকূলীয় এলাকার নারীরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে জরায়ু ক্যানসারের মতো জটিল রোগে ভুগেন।

 

এছাড়া লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর গর্ভপাতের হার বেড়েছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, অপরিকল্পিত গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্মের হার বেড়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলের নারীরা দৈনন্দিন কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে লিকোরিয়াসহ পানিবাহিত রোগ, চর্মরোগে ভুগেন।

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন শরুব ইয়ুথ টিমের তরুণ স্বেচ্ছাসেবক হৈমন্তী মণ্ডল। তিনি জানান, উপকূলে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ নারীর বেশির ভাগ সময় পানিতে কাটাতে হয়। তাদের উপার্জনের একমাত্র পথ মাছের ঘের, যেখানে লবণ পানির পরিমাণ বেশি।

উপকূলীয় অঞ্চলে নারীদের দিনের বেশির ভাগ সময় লবণাক্ত পানিতে অতিবাহিত করার জন্য তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। এ ছাড়া সচ্ছলতা না থাকায় তারা নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারেন না। ফলে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে, বাড়ছে মানসিক সমস্যাও। নারীর আর্থিক সচ্ছলতার জন্য বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে ধীরে ধীরে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি হাওর অঞ্চলও। গড় তাপমাত্রার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে, কিশোরী ও নারী, যাদের বয়স ১২-৪৫ বছরের মধ্যে, তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা যায়। ঋতুস্রাবের সময় থেকে শুরু করে মেনোপোজের সময় দেখা দেয় স্বাস্থ্যজনিত নানা সমস্যা।

 

এসব এলাকার নারীর মধ্যে প্রায় সময় অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ুতে সিস্ট, অসময়ে মেনোপোজসহ প্রজনন স্বাস্থ্যের নানা জটিলতা দেখা দেয়। কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে এ সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।

শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী বা কিশোরী যখন প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভোগেন, সে ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন কমিউনিটি পর্যায়ে যত স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাদের প্রত্যেককে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। এ ছাড়া জেলা পর্যায় বা উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন, তাদের মাধ্যমে মানসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়েও সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

লেখক: পরিবেশ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, মহিলা পরিষদ

মন্তব্য করুন


Link copied