নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবির আলোচনা ঝড় তুলেছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।
একদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে সোচ্চার, অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সরাসরি নিষিদ্ধ না চেয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলছে।
এই দাবির নেপথ্যে কি কেবল রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গভীর কোনো কৌশলগত হিসাব-নিকাশ? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের এই চাপ কেবল একটি দলের অস্তিত্বের প্রশ্ন নয়, বরং এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমীকরণের একটি অংশ, যা আগামী নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিটি হঠাৎ করে সামনে আসেনি। গত ২৯ আগস্ট জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণঅধিকার পরিষদের একটি বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘাত হয়। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় গণঅধিকার পরিষদের প্রধান নুরুল হক নুরের আহত হওয়ার ঘটনা এই দাবিকে আরও জোরালো করেছে। এই ঘটনা শুধু একটি সংঘাত হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে আরও বেশি জনসমক্ষে নিয়ে আসে এবং তাদের রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ‘ফ্যাসিবাদ’ বা ‘স্বৈরাচারের সহযোগী’ হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসনের অধীনে জাতীয় পার্টি গঠন ও ক্ষমতা ধরে রাখার ইতিহাস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এরশাদের পতনের পরও জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছে।
বিশেষ করে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করে এবং পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোয় অংশগ্রহণ করে জাতীয় পার্টি সমালোচিত হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে এই অভিযোগ জোরালোভাবে উপস্থিত হয়েছে যে তারা ওই নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগের ‘অবৈধ ক্ষমতা’ ধরে রাখতে সহায়তা করেছে এবং এর মাধ্যমে তারা ফ্যাসিবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ওঠা ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমাটিকে শক্তিশালী করেছে এবং তাদের নিষিদ্ধ করার দাবির একটি নৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছে।
তাদের মতে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে এবং ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই দলটি কাজ করে যাচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই দাবির পেছনে একটি বড় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ রয়েছে। তারা বলছেন, যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে, তাহলে জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপির মতো দলগুলোর জন্য আসন্ন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যা আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এই দলগুলোর অন্যতম কৌশল হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে ৩১ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। ওই বৈঠকে তিন দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে জুলাই সনদ, সংসদ নির্বাচন, নুরুল হক নুরের ওপর হামলা, জাতীয় পার্টি (জাপা) নিষিদ্ধকরণসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছে, তবে বিএনপি জানিয়েছে তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়।
জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের এই দাবিকে নিছক আদর্শিক বিরোধ হিসেবে দেখা হলে ভুল হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, এর পেছনে সুদূরপ্রসারী কৌশলগত হিসাব-নিকাশ এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন আনার আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব এজেন্ডা এবং নির্বাচনী লক্ষ্য থাকে, যা এই দাবির মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সরাসরি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, জাতীয় পার্টি ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর’ এবং অবৈধ নির্বাচনের বৈধতা দিয়েছে। এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের এই দাবির পেছনে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ বা ভোটের হিসাব নেই, বরং তারা একটি নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছেন, যা জুলাই সনদ, বিচার এবং সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর কাজ করবে।
একই কথা বলছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি মনে করেন, জাতীয় পার্টির কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশে রাজনীতি করার। তারা ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে গেছে। বাংলাদেশে সংস্কার হবে, নির্বাচন হবে ও নতুন সংবিধান হবে। জনগণের কাছে এটাই এনসিপির প্রতিশ্রুতি বলে তিনি জানান।
গত ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যমুনায় বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করার পক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান গাজীও একই সুরে মন্তব্য করেছেন। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এর মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই। ওই দলটি ভারতের তৈরি। আওয়ামী লীগও ভারতের তৈরি। দুটি দলই গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। জি এম কাদের ভারত থেকে ফিরে বলেছেন, সেখানে কী কথা হয়েছে তা প্রকাশ করা যাবে না। ভারতের পরিকল্পনায়ই এখন জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের চেষ্টা হচ্ছে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলছেন, জাতীয় পার্টির ওপর ভর করে কোনো দল ক্ষমতায় ফিরে পেতে পারে। একটি পক্ষ জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দল করতে চায়। তবে তার মতে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করার দাবিও জানান তিনি।
অন্যদিকে, বিএনপি জাতীয় পার্টিকে সরাসরি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। তারা জাতীয় পার্টিকে ‘স্বৈরাচারের সহযোগী’ হিসেবে বিচারের আওতায় আনার কথা বলছে। বিএনপির নেতাদের মতে, জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদের টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা করেছে এবং শেখ হাসিনা সরকারের ‘গণহত্যার দায়ে’ তারাও দায়ী। ১৯৭১ সালে রাজাকার আলবদররা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী ছিল, তাদের বিচার হলে জাতীয় পার্টিরও বিচার হওয়া উচিত, তবে তা প্রশাসনিক আদেশে নয়, বরং একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী এ প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী স্বেচ্ছাতন্ত্রের অন্যতম সহযোগী ছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে তারা রক্ষা করেছিল। ১৬ বছর জনগণের লক্ষ কোটি টাকা পাচারের সুবিধাও তারাই করে দিয়েছিল। ফলে যারা ফ্যাসিবাদকে সমর্থন ও ফ্যাসিবাদের বয়ানে সুর মিলিয়েছে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির এই অবস্থান তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে উৎসারিত। তারা জামায়াত ও এনসিপির চাপের মুখে পড়তে চায় না। তাদের মূল ফোকাস একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠা করা, যা পরে 'জুলাই সনদ' বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনে কাজ করবে।
বিএনপি শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলছেন, দলটি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য। একটি দলকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হলে তা একটি বিপজ্জনক চক্র তৈরি করতে পারে, যেখানে আজ এক দল, কাল আরেক দল নিষিদ্ধের দাবি উঠবে।
জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবির পেছনে একাধিক রাজনৈতিক ও ভোটের সমীকরণও কাজ করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তারা বলছেন, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হবে। এই শূন্যতা পূরণের জন্য জামায়াতে ইসলামী একটি বড় সুযোগ পাবে। সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ে (সানেম) তরুণদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, যেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
এই জরিপ যদি বাস্তবতার কাছাকাছি হয়, তাহলে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে তার প্রায় ৩-৭ শতাংশ ভোট সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জামায়াত বা এনসিপির মতো ইসলামী দলগুলোর দিকে ধাবিত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ফলে তা জামায়াতকে আসন্ন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার একটি বড় সুযোগ দেবে এবং দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও ডানপন্থী বা ইসলামপন্থী ধারায় ঠেলে দেবে। জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থায় ছিল, এই সুযোগ তাদের জন্য রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে ফিরে আসার একটি নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনের মাঠে না থাকলে জামায়াত ও এনসিপিসহ অন্যান্য দলগুলোর পক্ষে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করা সহজ হবে। তখন বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের পক্ষে অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য বড় দল থাকবে না, যা বিএনপিকে কঠিন কৌশলগত অবস্থানে ফেলবে। এছাড়া, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করার পক্ষদের অভিযোগ— এই দলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়া অনেক আওয়ামী লীগ নেতা জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, যা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল এবং ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যদিও সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী তাদের ভোট ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে, তবুও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে ভোটের নতুন একটি চিত্র দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির মতো দলগুলো ইতোমধ্যেই পিআর এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবিতে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। এই ধারাবাহিকতায় জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তাদের বৃহত্তর নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে এটি আন্তর্জাতিক মহলে আসন্ন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পেছানোর বা এমনকি বাতিল হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
এই কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে, উল্লেখিত দলগুলো একটি বিশেষ রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করতে চাইছে। যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে তাদের ঐতিহ্যবাহী ভোট ব্যাংক এবং রাজনৈতিক প্রভাব অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এটি জামায়াত ও এনসিপির মতো দলগুলোর জন্য আসন্ন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার একটি বড় সুযোগ তৈরি করবে বলে তারা মনে করছেন।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটি বড় রাজনৈতিক দলকে প্রশাসনিক আদেশে নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনা বিদেশি পর্যবেক্ষক এবং সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এর ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ বাড়তে পারে এবং নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে, যা নির্বাচন পেছানো বা নতুন নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার পথ খুলে দিতে পারে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, যদি একটি রাজনৈতিক দলকে প্রশাসনিক আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এটি একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবে। ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর করার জন্য একই ধরনের দাবি তুলতে পারে। এটি ‘নিষিদ্ধের সংস্কৃতি’ তৈরি করবে, যেখানে রাজনৈতিক বিতর্কের পরিবর্তে প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ করার প্রবণতা বাড়বে। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেবে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্ম দেবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগের হাতে যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে তার দায় জাতীয় পার্টিরও আছে। আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলেই তারা আওয়ামী লীগের সহচর হিসেবে ছিল, নানা সুবিধাও নিয়েছে। দেশের একটা বড় অংশের মানুষের তাই জাতীয় পার্টির প্রতি ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এই ক্ষোভ থেকে নিষিদ্ধের দাবি কেউ করতেই পারে।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ সোহরাব হোসেন বলেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি নির্বাচন বানচালের কৌশল হতে পারে। এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে তারা ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল, এটাও সত্য। এখন জনগণের সরকার বিদ্যমান, জনগণ যা চাইবে, তাই তো হবে। আর কিছু আমি বলতে পারছি না আপাতত।
যদিও সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, আজ যাদের ফ্যাসিস্ট বলা হচ্ছে, তাদের নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। কাল অন্য কেউ ক্ষমতায় গিয়ে ফ্যাসিস্ট আচরণ করলে তাকেও নিষিদ্ধের দাবি উঠবে। এই নিষিদ্ধের চক্র চলতেই থাকবে। এর চেয়ে ভালো জনগণকে নির্ধারণ করতে দেওয়া।
বিশ্লেষকদের মতে, গণতন্ত্রে জনগণের রায়ই চূড়ান্ত। জনগণ কাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় এবং কাকে বিরোধী দলের আসনে বসাবে, তা ভোটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। নিষিদ্ধের এই চক্র চলতেই থাকলে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। প্রপাগান্ডা দিয়ে নয়, বরং বাস্তব রাজনীতির মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।