আর্কাইভ  রবিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ● ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০২৫
হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে

হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে

হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রায় ২৭ নভেম্বর

প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি
হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রায় ২৭ নভেম্বর

হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের মামলার যুক্তিতর্ক ২৫ নভেম্বর

হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের মামলার যুক্তিতর্ক ২৫ নভেম্বর

রাজনীতি ছেড়ে 'পাপমুক্ত' হতে দুধ দিয়ে গোসল!

রাজনীতি ছেড়ে 'পাপমুক্ত' হতে দুধ দিয়ে গোসল!

মোবাইল আসক্তি ও নতুন প্রজন্মের নীরব সংকট

রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫, দুপুর ০২:২৫

Advertisement

মোঃ শফিকুল ইসলাম ইরফান

আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে দ্রুত, গতিশীল ও সহজ করে তুলেছে—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রযুক্তির এই সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব বিপদ, যার নাম মোবাইল আসক্তি। বিশেষ করে কিশোর-তরুণ প্রজন্ম এখন এমন এক সংকটে পড়েছে যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন আজ যোগাযোগের সহায়ক নয়, বরং এক অদৃশ্য শিকলে নতুন প্রজন্মকে বেঁধে ফেলছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ১৮ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, যার বড় অংশ তরুণ। UNICEF-এর ২০২৪ সালের একটি জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরদের ৬৮ শতাংশ প্রতিদিন অন্তত ৪ ঘণ্টার বেশি সময় মোবাইলে ব্যয় করে। বিশ্বব্যাপী চিত্রটাও একই রকম। "কমন সেন্স মিডিয়া"র এক গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী তরুণরা প্রতিদিন গড়ে ৭ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনের সামনে থাকে—যা স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ। WHO জানায়, প্রতিদিন ২ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মোবাইল আসক্তির উৎস খুবই সাধারণ। বিনোদনের অবাধ প্রলোভন, টিকটক বা রিলসের দ্রুত উত্তেজনা, অনলাইন গেমের প্রতিযোগিতা, সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন—সব মিলে তরুণদের মস্তিষ্কে এক ধরনের মুহূর্তিক আনন্দ তৈরি করে। পড়াশোনার অজুহাতে বা ফাঁকেফাঁকে মোবাইল ব্যবহার করতে করতে তারা কখন যে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তা নিজেরাও টের পায় না। পরিবারে ব্যস্ততা, তদারকির অভাব ও একাকীত্বও এই আসক্তিকে আরও গভীর করে তোলে।

এই আসক্তির ফলাফল নীরব কিন্তু ভয়াবহ। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৫ ঘণ্টার বেশি মোবাইল ব্যবহার করে তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি। ঘুমের ব্যাঘাত, মনোযোগের ঘাটতি, স্মরণশক্তি দুর্বল হওয়া—এসব এখন নতুন প্রজন্মের পরিচিত সমস্যা। রাত জেগে অনলাইন গেম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফল খারাপ হচ্ছে। WHO-এর তথ্য বলছে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম কিশোরদের প্রতিরাতে গড়ে ১.৫ ঘণ্টা ঘুম কমিয়ে দিচ্ছে, যা তাদের শারীরিক বিকাশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। চোখে ব্যথা, মাথা ধরা, ঘাড় ও মেরুদণ্ডের সমস্যাও এখন মোবাইল-নির্ভর জীবনের সহযাত্রী হয়ে উঠেছে।

আরেকটি বড় ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক জীবনে। একই ঘরে বসে পরিবারের সদস্যরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা না বলে মোবাইলের পর্দায় ডুবে থাকে, তখন সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ে। সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের যোগাযোগ কমে যায়, যার ফলে কিশোররা অনেক সময় সিদ্ধান্তহীনতা, একাকীত্ব বা ভুল পথে ঝুঁকে পড়ে। একসময় পরিবার ছিল সন্তানের আচরণ গঠনের প্রধান শক্তি; এখন সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়া।

মোবাইল আসক্তি কমাতে সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে বড় শক্তি। পরিবারকে সন্তানের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে হবে এবং নিজেরাও মোবাইল ব্যবহারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটাল আসক্তির ঝুঁকি নিয়ে আলাদা সচেতনতা কার্যক্রম থাকা জরুরি। তরুণদের বিকল্প বিনোদন—বই পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা—এসবের সুযোগ তৈরি করতে হবে। প্রযুক্তিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করলে এটি সুবিধার চেয়ে বেশি ক্ষতি ডেকে আনে।

প্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যখন এই উপকারী যন্ত্রই হয়ে ওঠে মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতির কারণ, তখন তা এক নীরব সংকটে পরিণত হয়। নতুন প্রজন্মকে এই ফাঁদ থেকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নইলে আমরা ডিজিটাল অগ্রগতির মাঝে এক পুরো প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলতে পারি—অদৃশ্য কিন্তু গভীর এক আসক্তির কারণে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর। 

মন্তব্য করুন


Link copied