নিউজ ডেস্ক: ছয় বছর আগের এই দিনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার পর বুয়েটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফুঁসে ওঠে।
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। হত্যার দায়ে ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়।
আবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক্স প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি শেরে বাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন। আবরার ফাহাদকে যেদিন হত্যা করা হয়, তার আগেরদিন ৫ অক্টোবর শনিবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এসময় তিনি বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
স্ট্যাটাসে আবরার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করেন। ভারতের সঙ্গে পানি বিনিময়, মোংলা বন্দর ব্যবহার এবং গ্যাস রপ্তানির সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
পরদিন রোববার বিকেলে তিনি হলে ফেরেন। হলে ফেরার কয়েক ঘণ্টা পর রাত ৮টার দিকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের সাত-আটজন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা।
এসময় তারা আবরার ফাহাদের মোবাইল ফোন চেক করেন। এরপর স্ট্যাম্প দিয়ে তাকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতাকর্মী আসেন। তারা আরেক দফা পেটান আবরারকে।
রাত ৩টার দিকে জানা যায়, আবরারকে মেরে দোতলা ও একতলা সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছে। বুয়েটের তৎকালীন মেডিকেল ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবরার ফাহাদের মৃত্যুর বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নির্মিত ডকুমেন্টোরিতে কথা বলেন তার ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ। তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম, ভাইয়ার পায়ের দিকে ধরব, কিন্তু গ্রিপ করতে গিয়ে দেখি কিছু নেই। সব গলা। জাস্ট হাড্ডিতে গিয়ে গ্রিপ করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ৬ তারিখ সকাল সাড়ে ৯টায় ভাইয়ার বাস ছিল। হলে আসতে আসতে সাড়ে ৪টা বেজে গেছে। আম্মুর দেওয়া খাবার খেয়ে ভাইয়া রেস্ট নিচ্ছিল। এর মধ্যেই ভাইয়ার কাছের বন্ধুরা এসে তাকে বলেছে, বড় ভাইয়েরা তোকে ডাকছে, একটু ওপরে আয়। সঙ্গে ল্যাপটপ-মোবাইল নিয়ে আয়।
ডকুমেন্টরিতে কথা বলেন তার সহপাঠী মুহতাদি আহনাফ আনসারী। তিনি বলেন, তাকে থাপ্পড় দেওয়া হয়। পাশের রুম থেকে স্ট্যাম্প নিয়ে আসা হয়। অমানুষিকভাবে তাকে হিট করা হয়। একটা পর্যায়ে স্ট্যাম্প ভেঙে যায়। এরপর আরেকটি স্ট্যাম্প নিয়ে তাকে মারা হয়। সেসময় সে মেঝেতে পড়ে যায়। বমি করে।
তিনি আরও বলেন, তাকে মারতে মারতে তার তলপেটে হিট করা হয়। মৃত্যুর পর আমরা দেখেছিলাম, তার দুই-হাত, দুই পা কালছিটে পড়ে গিয়েছিল। শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তাকে হিট করা হয়নি। সে যখন অনেক বমি করে ফেলে, তখন তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে ওয়াশ করা হয়, এবং রুমে নিয়ে আবার মারা হয়। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে তারা ওয়াশ করে ফাহাদকে ২০১১ থেকে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। আবরারকে গ্রেপ্তার করতে ইতোমধ্যে পুলিশকে বলে দেওয়া হয়েছিল এবং পুলিশ ফটকের বাইরে অপেক্ষা করছিল।
মুহতাদি আহনাফ বলেন, তাকে যখন সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে রাখা হয়, তখন সে বলেছিল, তাকে নিয়ে টানাটানি না করতে, সে একটু পানি খেতে চায়। আমি যখন বেরোতে চাই, তখন সেখানে শামীম বিল্লাহ এবং সাইফুল ছিল, তারা মিলে পানি খাওয়াচ্ছিল।
তিনি বলেন, কিছুক্ষণ পর আমি যখন পৌঁছাই, তখন তার আর হুশ ছিল না। তখনও তার এক্সটার্নাল কোনো ব্লিডিং ছিল না। কিন্তু তার সেন্স ছিল না। আমরা তাকে সিপিআর দেই। সিপিআর দেওয়ার সময় তার মুখ থেকে যে আওয়াজ আসছিল, আমরা ভেবেছিলাম হয়তো কফ আটকে গিয়েছে। বসে কিছুক্ষণ পিঠের ওপর বাড়ি দিতে থাকি। হয়তো কফ ক্লিয়ার হবে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আসে।
এ বিষয়ে দায়িত্বরত ডাক্তার বলেন, আমি তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি, সে মৃত। তখন দেখি, তার শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন। পরে চকবাজার থানা পুলিশ আসে এবং তার সুরতহাল রিপোর্ট করে।
কেন হত্যা করা হয়েছিল আবরারকে
আবরার ফাহাদকে ফেসবুক পোস্টে ভারতের সমালোচনার জেরেই হত্যা করা হয়েছিল বলে হত্যার পরপরই জোর আলোচনা ওঠে। এসময় তাকে ‘শিবির’ ট্যাগ দেওয়া হয়। ঘটনাটির তদন্ত শেষে তখনকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আবরার ফাহাদকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করার বিষয়টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
তিনি বলেন, অভিযুক্তদের সমীহ করে সালাম না দেওয়ার বিষয়টিও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ। তারা র্যাগিং-এর নামে আতঙ্ক তৈরি করেছে। হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে অন্যদের মাঝেও আতঙ্ক তৈরি করতে চেয়েছিল, যাতে করে অন্য শিক্ষার্থীরাও তাদের সমীহ করে এবং সালাম দেয়।
তবে তৎকালীন সক্রিয় ছাত্রনেতা ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা মনে করেন ভিন্নমত পোষণ এবং ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়। তারা আবরার ফাহাদকে ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে আবরার ফাহাদকে সার্বভৌমত্ব ও আগ্রাসনবিরোধী প্রতীক হিসেবেও ঘোষণা করেন তাদের অনেকেই।
আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর পলাশীতে তার স্মরণে ‘আগ্রাসনবিরোধী স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করেন বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ কয়েকজন। তিনিও আবরারকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে জীবন দিতে হয়েছিল বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার আজ থেকে ছয় বছর আগে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। তাই আমরা এই স্থাপনাটির নাম দিয়েছিলাম আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ। স্থাপনাটি আজ আবার উদ্বোধন হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
মৃত্যর আগে আবরার ফাহাদের ফেসবুকে দেওয়া পোস্টও ছাত্রলীগ নেতাদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার মূল কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই।
এসময় তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন-
১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্র বন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সেই মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। ...
কারা শাস্তি পেলেন
এ ঘটনার পরদিন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনার পর মাত্র ৩৭ দিনে তদন্ত শেষ করে ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান। পরে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। চলতি বছর হাইকোর্ট মামলার রায় বহাল রাখেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এ এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল), মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল), এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) এবং মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল)। এর মধ্যে শেষের তিনজন পলাতক রয়েছেন।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।