নিউজ ডেস্ক: সব জল্পনা-কল্পনা ও শঙ্কার অবসান ঘটিয়ে রাত পোহালেই বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বিরাজ করছে উৎসবমুখর ও রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ। শিক্ষার্থীরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এবারের ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার ও ন্যায্য দাবি পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে সৃষ্ট নানান বিতর্কের অবসান ঘটবে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টা থেকে টানা ৩৪ ঘণ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রবেশপথ সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে—ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সোমবার রাত ৮টা থেকে বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ শাহবাগ, পলাশী, দোয়েল চত্বর ও নীলক্ষেত এলাকা সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ আইডি কার্ডধারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঢুকতে পারবেন। এছাড়া নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত কার্ডপ্রাপ্ত সাংবাদিকরাও প্রবেশ করতে পারবেন।
এদিকে, ডাকসু নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ নির্দেশ দেন।
ভোটার, প্রার্থী ও নারী প্রার্থীর সংখ্যা
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫- এ মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৬৩৯ জন। তাদের মধ্যে ১৮ হাজার ৯৫৯ জন নারী ভোটার। যা ভোটারের ৪৮ শতাংশ। ডাকসুর ২৮টি পদে মোট প্রার্থী আছেন ৪৭১ জন। তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী ৬২ জন, যা মোট প্রার্থীর মাত্র ১৩ শতাংশ। এবার ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে মোট প্রার্থী ৪৫ জন। এর মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ৫ জন। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রার্থী ১৯ জন, সেখানে মাত্র ১ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন।
নির্বাচনি বুথ, ছবি: নাসিরুল ইসলামভোটকেন্দ্র ৮টি
এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৮টি। কেন্দ্রগুলো হলো:
১. কার্জন হল কেন্দ্র (পরীক্ষার হল): ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল, ফজলুল হক মুসলিম হল।
২. শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র: জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।
৩. ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি): রোকেয়া হল।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্র: বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল।
৫. সিনেট ভবন কেন্দ্র (অ্যালামনাই ফ্লোর, সেমিনার কক্ষ, ডাইনিং কক্ষ): স্যার এ এফ রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, বিজয় একাত্তর হল।
৬. উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র: সূর্যসেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, কবি জসীম উদ্দীন হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল।
৭. ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্র: সেখানে ভোট প্রদান করবেন কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা।
৮. ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজ কেন্দ্র: এই কেন্দ্রে ভোট দেবেন শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থীরা।
কোন কেন্দ্রে কত ভোট
কার্জন হল কেন্দ্র: ৫০৭৭ ভোট, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র: ৪৮৫৩ ভোট, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি): ৫৬৬৫ ভোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্র: ৪৭৫৫ ভোট, সিনেট ভবন কেন্দ্র: ৪৮৩০ ভোট, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ: ৬১৫৫ ভোট, ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্র: ৪৪৪৩ ভোট, ইউনিভার্সিটি ল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজ: ৪০৯৬ ভোট।
নির্বাচন কমিশন: দায়িত্বে আছেন যারা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের জন্য ১০ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনকে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়েছে। প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সাহায্য করতে আরও ৯ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন—মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মহিউদ্দিন, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোস্তাক গাউসুল হক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. শহিদুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শারমীন কবীর।
ভোট গণনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতে থাকবে এলইডি স্ক্রিন
এবারের নির্বাচনে ভোট গণনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে এলইডি স্ক্রিন বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই স্ক্রিনে ভোট গণনা সরাসরি দেখানো হবে, যা ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
এলইডি স্ক্রিন বসানোর সিদ্ধান্তকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, স্বচ্ছতা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাদের প্রত্যাশা, একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রাব্বি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিগত সময়ে ডাকসুর কোনও নির্বাচনেই এলইডি স্কিনের ব্যবহার হয়নি। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং নির্বাচনে ভোট গণনায় স্বচ্ছতা দেখানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আশা করি এবারের নির্বাচনে এবং ভোট গণনায় কোনও কারচুপি হবে না।’
জুলাই বিপ্লবের নেতারাই নেতৃত্ব দেবেন ডাকসুতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তানজীর হোসেন বলেন, ‘ডাকসুতে ভিপি প্রার্থী হিসেবে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের তালিকায় রয়েছে আবিদ, কাদের, উমামা ও সাদিক কায়েম। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার বিষয় এই চার জনেই জুলাই বিপ্লবে প্রথম সারিতে ছিলেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শামীমের কথাবার্তা ও প্রতিশ্রুতি কিন্তু শিক্ষার্থীদের মন ছুঁয়েছে।’
তানজীর বলেন, ‘জিএস প্রার্থীদের মধ্যে বাকের, হামিম, ফরহাদ এরাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ক্যান্ডিডেট। তারা তিন জনেই কিন্তু জুলাইয়ের নায়ক। বিশেষ করে বাকের ও হামিমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য পদে যারা আছেন কম বেশি সবাই জুলাই বিপ্লবের সময় প্রথম বা দ্বিতীয় সারিতে ছিলেন। তাই বলা যায়, জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরাই ডাকসুতে নেতৃত্ব দেবেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী রেজাউল করিম বলেন, ‘ডাকসুতে এবার কেউ হারবে না, সবাই জিতে যাবে। কারণ এরা সবাই জুলাই আন্দোলনে হাতে হাত রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জুলাই আন্দোলনের সময় দলমত নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে এসে হাসিনার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে ছিলেন এবারের ডাকসুর প্রার্থীরা। নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সময়ও তাদের মধ্যে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, দলমতের ঊর্ধ্বে একে অপরের প্রতি যেভাবে সম্মান প্রদর্শন, তা শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
ডাকসু নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৭ বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) হন সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর এবং সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) গোলাম রাব্বানী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান।
স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনীহা পরিলক্ষিত হয়, যার ফলে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৯ বার নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৭ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে ডাকসু নির্বাচন একেবারে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যায়।
ডাকসু নির্বাচন: যা বললেন সাবেক তিন ভিপি
ডাকসুর সাবেক ভিপি (১৯৭২-৭৩) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘পরীক্ষার তারিখের মতোই ডাকসু নির্বাচনের তারিখ অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে থাকতে হবে। প্রতিবছর এটা নিয়মিত হবে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন ভয়েস যেন উঠে আসে।’
ডাকসুর সাবেক দুইবারের ভিপি (৭৯-৮০ ও ৮০-৮১ সেশন) মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ডাকসুর কমবেশি সবাই এখন জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করছেন। রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ এবং স্মার্ট নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য হলেও নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত।'
ডাকসুর সাবেক ভিপি (৯০-৯১) আমানউল্লাহ আমান বলেন, 'ডাকসু হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সংসদ। ডাকসু নির্বাচন প্রতিবছরই হওয়া উচিত। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠে।’