নিউজ ডেস্ক: রাত পোহালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হবে, চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এ নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে টানটান উত্তেজনা।
তবে শিক্ষার্থীরা চান ‘সৌহার্দ্য’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ পরিবেশে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যাশা, প্রার্থীরা ভোটের দিনে ও ফল ঘোষণার পর সহনশীল আচরণ করবেন। সুষ্ঠু ভোটের পর তারা যাতে জয়-পরাজয় মেনে নেন, সেটাই চাওয়া শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ডাকসু নির্বাচন করে ইতিহাস গড়তে চায় ঢাবি প্রশাসন।
ক্যাম্পাসে ভোট ঘিরে জল্পনা, সবার চাওয়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশ
টানা ১৩ দিন ক্যাম্পাসজুড়ে প্রচার-প্রচারণার পর সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) ক্যাম্পাসের পরিবেশ ছিল তুলনামূলক শান্ত। সাইবার হামলা ইস্যুতে সাময়িক উত্তেজনা ছড়ালেও তা দ্রুতই কেটে যায়।
তবে দিনভর ক্যাম্পাসজুড়ে চলেছে ভিপি-জিএস-এজিএসসহ গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গ্রুপ স্টাডি থেকে শুরু করে সব জায়গার আলোচনায় ডাকসুর ভোটের সমীকরণ।
ক্যাম্পাসের মল চত্বরে সোমবার দুপুরে আড্ডা দিতে দেখা যায় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছয় শিক্ষার্থীকে। তারা সবাই সহপাঠী।
আগামীকাল ডাকসুর ভোট, কেমন নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন—এমন প্রশ্নে মো. রহমতুল্লাহ নামে এক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হোক, শান্তিপূর্ণ হোক। আমরা চাই, প্রচার-প্রচারণার ১৩ দিনে যেমন মারামারি-কাটাকাটি হয়নি, ভোটের দিনেও সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকুক।’
পাশেই বসা রহমতুল্লাহর সহপাঠী আসমা বিনতে নাইম বলে ওঠেন, ‘শুধু আগামীকাল নয়, নির্বাচনের পরেও যাতে কেউ সংঘর্ষ না বাধায়, সেটাই চাওয়া আমাদের। শিক্ষার্থীরা যাকে ভোট দিয়ে জয়ী করবে, তাকেই যেন সবাই মেনে নেন। ঢাবির শিক্ষার্থী হিসেবে এটুকু সহনশীল আচরণ সব প্রার্থীর কাছে আমরা প্রত্যাশা করি।’
নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানেও ডাকসু নিয়ে আলোচনা। সেখানে এ মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স কিনতে আসা জ্যোতি নামে এক ছাত্রী বলেন, ‘এবার নারীদের মধ্যে কেউ ভিপি হলে খুশি হবো। তবে যেই জিতুক, অন্যদের মেনে নেওয়া উচিত হবে। আর ভোটের দিনে কেউ কাউকে জোরাজুরি যাতে না করে—এটা শুধু আমার না, সব শিক্ষার্থীর চাওয়া।’
ছাত্রদল চায় সুষ্ঠু ভোটের গ্যারান্টি, ফল মেনে নেবে শিবির
শিক্ষার্থীরা সব পক্ষকে সহনশীল হওয়ার অনুরোধ করলেও নির্বাচন ঘিরে প্রচ্ছন্ন উত্তেজনা রয়েছে ক্যাম্পাসজুড়ে। নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আলোচিত সব প্যানেলের প্রার্থীরা। সবার ভাষ্য প্রায় একই রকম, ‘একটি বিশেষ সংগঠনের প্রার্থীদের সুবিধা দিচ্ছে প্রশাসন।’
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ। ডাকসু নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রশাসন নিশ্চিত করতে পারছে না বলে অভিযোগ তার। মায়েদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই দেখছি, একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনকে প্রশাসন প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাদের প্রতি অলিখিত সমর্থন দেখছি। এ নিয়ে বারবার অভিযোগ করে এলেও প্রশাসন তা গায়ে মাখছে না। আগামীকালের ভোটে যদি একই অবস্থা দেখা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা তা মানবে না। তার দায়ও প্রশাসনকেই নিতে হবে।’
অন্যদিকে, ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্যানেলের এজিএস মহিউদ্দিন খান জানান, তারা ‘শিক্ষার্থীদের রায় মাথা পেতে’ নেবেন। শিবিরের ঢাবি শাখার সেক্রেটারি বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণায় আমরা অনেকক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়েছি। বহু অভিযোগ করেছি। তা নিয়ে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতে, ডাকসুকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আগামীকাল শিক্ষার্থীরা যে রায় দেবেন, তা আমরা মেনে নেবো।’
‘সুষ্ঠু ডাকসু ভোটে ইতিহাস সৃষ্টি করবে ঢাবি’
ডাকসু নির্বাচনে চিফ রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণায় ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেক প্যানেলের প্রার্থীরা করেছেন বলে অভিযোগ ছিল। আমরা তাৎক্ষণিক সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আটটি কেন্দ্রের ৮১০টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে। সবগুলো বুথ প্রস্তুত। আগামীকাল সকালে সবার সম্মুখে খালি ব্যালট বাক্স প্রদর্শন করা হবে। এরপর ভোটগ্রহণ করা হবে। সবার আন্তরিক সহযোগিতায় শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ডাকসু ভোটের মাধ্যমে ঢাবি ইতিহাস সৃষ্টি করবে।’
ডাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগের দিন ভিডিওবার্তা দিয়েছেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। এবারের ডাকসু নির্বাচনকে ‘ঐতিহাসিক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এবারের নির্বাচনটি বিভিন্ন কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন ঐতিহাসিক। এবার এমন অনেক কিছু আমরা করেছি, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে আগে ঘটেনি।’
শিক্ষার্থীদের নির্ভয়ে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে উপাচার্য বলেন, ডাকসু তোমরা চেয়েছো, গভীরভাবে প্রত্যাশা করেছো, গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণও। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সমন্বিত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভয়েস তৈরি করার জন্য এটা (ডাকসু) জরুরি। নির্ভয়ে তোমরা ভোট দিতে আসবা, আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।
উপাচার্য বলেন, ‘যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন, তারা বিভিন্নজন বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ। তবে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখছেন। আমরা এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে ভোটগণনা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেবো। ব্যাপকসংখ্যক সাংবাদিক থাকবেন। তারা মনিটরিং করবেন।’
জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে উল্লেখ করে প্রার্থীদের উদ্দেশে অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘যেহেতু নির্বাচন প্রক্রিয়া; কিছু প্রার্থী জিতবেন, কিছু প্রার্থী জিতবেন না। জয়-পরাজয় থাকবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিজয়ী এবং বিজিত উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। গণতান্ত্রিক একটি প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয়করণ বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আপনার ভূমিকা পালন করলেন।’
তফসিল অনুযায়ী— মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হবে। ক্যাম্পাসের আটটি কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। নির্বাচনে একজন ভোটারকে মোট ৪১টি ভোট দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সংসদে ২৮টি, হল সংসদে ১৩টি পদে। ভোটগণনা শেষে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ফল ঘোষণা করা হবে।
ডাকসুতে মোট ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন ভোটারের মধ্যে ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯ জন এবং ছাত্র ২০ হাজার ৯১৫ জন। নির্বাচনে ২৮ পদের বিপরীতে লড়ছেন মোট ৪৭১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে পুরুষ প্রার্থী ৪০৯ জন ও নারী প্রার্থী ৬২ জন।
কোন পদে কত প্রার্থী
সহ-সভাপতি (ভিপি) ৪৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ১৯ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ২৫ জন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ১৭ জন।
কমনরুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক ১১ জন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ১৪ জন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ১৯ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ১২ জন, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক নয়জন।
ক্রীড়া সম্পাদক ১৩ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক ১২ জন, সমাজসেবা সম্পাদক ১৭ জন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক ১৫ জন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক ১১ জন, ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক ১৫ জন। এছাড়া ১৩টি সদস্যপদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ২১৭ জন।