আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫ ● ৪ ভাদ্র ১৪৩২
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫

হুমায়ূনের আঁতুরঘর অথবা জোছনার ফুল

শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, দুপুর ০৩:০২

Advertisement Advertisement

নিউজ ডেস্ক: হেমন্তের কুয়াশার রাতে জন্ম হয়েছিল তাঁর। হাওরপাড়ের রূপ আর রহস্যময়তা সঙ্গী হয়েছিল তাঁর জন্মের। হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের নন্দিত নরকের নন্দিত কথাসাহিত্যিক। আজ তাঁর ৬৯তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে তাঁর আঁতুড়ঘর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, দাদাবাড়ি কেন্দুয়ার কুতুবপুর আর স্বপ্নের ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে’র গল্পই বলব এখানে।

ভাটি বাংলার দুয়ার মোহনগঞ্জের শিয়ালজানীপাড়ের শেখবাড়ি। নিভৃত পল্লীর এই বাড়িটিই হুমায়ূন আহমেদের নানাবাড়ি। জন্মভিটার চারপাশ এখনো শান্ত-স্নিগ্ধ সজল সবুজময়। এখনো সাঁঝের আঁধারে কিংবা রাতের প্রহরে দলে দলে ডেকে ওঠে শিয়াল। সাঁঝবেলার মেলার আগেই ডানা মেলে বাদুড়। দিনের বেলা দেখা যায়, গাছে গাছে শাখায় শাখায় উবু হয়ে ঝুলে আছে শত বাদুড়। রাতের চাঁদের জোছনা গাছপালার পাতার ফাঁকে নেমে এসে সৃষ্টি করে আলো-ছায়ার রহস্যময়তা।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে জন্ম প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শোনা কথা’—শিশুর কান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র তিনি ছুটে এসে বললেন, ছেলে না মেয়ে? ডাক্তার সাহেব রহস্য করবার জন্য বললেন, মেয়ে, ফুটফুটে মেয়ে। নানাজান তৎক্ষণাৎ আধমণ মিষ্টি কিনতে লোক পাঠালেন।

নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীত। গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসম্ভব শীতল হাওয়া। মাটির মালশায় আগুন করে নানিজান সেক দিয়ে আমাকে গরম করার চেষ্টা করছেন। আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কালান্তক জ্বর। টাইফয়েড। তখন টাইফয়েডের ওষুধ বাজারে আসেনি। আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো নানাজানের কাছে। সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জ। আমার নানিজান আমাকে লালন-পালনের ভার গ্রহণ করলেন। তখন তাঁর একটি মেয়ে হয়েছে। তাঁর এক কোলে সেই মেয়ে, অন্য কোলে আমি। নানিজানের বুকের দুধ খেয়ে দুজন একসঙ্গে বড় হচ্ছি। দুই বছর এমন করেই কাটল।

হুমায়ূনের নানি তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘বাচ্চু’।

সরকারি চাকরির সুবাদে তাঁর বাবা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করলেও হুমায়ূনকে জন্মের অতি শৈশব থেকে, শৈশবের দীর্ঘ একটা সময় এখানে কাটাতে হয়েছে অনিবার্য কারণেই। ফলে এখানকার মাটি-আলো-বাতাস প্রকৃতির প্রভাব হুমায়ূনের মাঝে মিশে গেছে সেই শৈশবেই। এখানকার মরমি বাতাস ছুঁয়ে গেছে হুমায়ূনের প্রাণ। তাঁর মামার বাড়ি, মামারা, নানা-নানির প্রসঙ্গ, আশপাশের মানুষ, মানুষের জীবনের ছায়াপাতও উঠে এসেছে তাঁর লেখালেখিতে।

হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে আট বছরের ছোট মো. মাহবুবুন নবী শেখ। তাঁর ছোট মামা। একসময়কার মেয়র মাহবুবুন নবী স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন, ‘আমি যখন এলাকায় নির্বাচন করি, সে সময় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। নির্বাচনের দুই দিন আগে তাঁর উপস্থিতি বদলে দিয়েছিল নির্বাচনী হিসাব।’

এই বাড়ির পেছনে পারিবারিক কবর। এখানেই ঘুমিয়েছেন মা আয়েশা ফয়েজ।

নেত্রকোনা জেলার আরেক প্রান্তে কেন্দুয়া থানা। এখানকার কুতুবপুর গ্রামই হুমায়ূনের দাদাবাড়ি। সেই বাড়িতে হুমায়ূনকে শুধু বাচ্চু নয়, ডাকা হতো ‘কাজল’ নামেও। এই কাব্যিক নামটিই পছন্দ করেছিলেন হুমায়ূনের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ। বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন হুমায়ূনের বাবার দাদাজান।

ছোটবেলায় মাকড়সা ভয় পেতেন হুমায়ূন। রাতে ঘুমানোর সময় তাঁকে ছড়া শোনাতেন চাচা আলতাফুর রহমান আহমেদ। ছড়া শুনেও ঘুম পেত না হুমায়ূনের। হুমায়ূনের পাঁচ চাচার মধ্যে একমাত্র অশীতিপর এই চাচাই এখন বেঁচে আছেন। বলছিলেন, ছোটবেলায় দারুণ মেধাবী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূনের দাদাজান বলতেন, বড় হলে হুমায়ূন অনেক মানুষের সেবা করবে।

মরমি বাতাসে বেড়ে উঠেছেন হুমায়ূন। ভাটির দেশে সুখী নীলগঞ্জের স্বপ্নের মতোই দাদাজানের বাড়ি ঘেঁষে গড়েছেন শিক্ষালয়। মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের স্মৃতির স্মরণে সেই ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ আজ গোটা অঞ্চলের গর্ব।

১৯৯৬ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হওয়া এই বিদ্যালয় নেত্রকোনা জেলায় ফলাফলে বরাবরই শীর্ষে থাকে। দারুণ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি স্কুলের ক্লাসরুমগুলো। প্রতিটি ক্লাসরুমে ৩০ জন শিক্ষার্থীর বসার ব্যবস্থা। হুমায়ূন বলতেন, একজন শিক্ষকের এর চেয়ে বেশি শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে শিক্ষাদান সম্ভব নয়।

এই শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসে। কেউ হেঁটে, কেউ বা সাইকেলে চড়ে। স্কুলে আসার রাস্তা নানা জায়গায় ভাঙাচোরা।

২০১১ সালে শেষ সংস্কার হয়েছে স্কুলের। অর্থাভাব প্রকট। তাই ধুঁকছে হুমায়ূনের ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’।

থমকে আছে স্কুলটির এমপিওভুক্তি। শিক্ষামন্ত্রী আশা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন আজো হয়নি।

হাওর মিশে আছে হুমায়ূনের জীবনে। ছুটিছাটায় ছুটে আসতেন মামা আর দাদাবাড়িতে। খোঁজখবর নিতেন স্কুলের।

পূবালি বাতাসে এখানে আজও বিরহী উকিলের কান্না শোনা যায়। সেই কান্না হুমায়ূন আহমেদও শুনতে পেয়েছিলেন শৈশবেই। সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের শৈশব-কৈশোর হুমায়ূন আহমেদের জন্মভিটা এক কিলোমিটারের মাঝেই। পূর্ণিমায় জোছনা এখানে থৈথৈ করে।

হাওরের ওপারে বাউল শাহ করিমের কালিনী নদীর বাঁক। এখানে চাঁদ শুধু আকাশেই ওঠে না, টলটলে জলের নিচেও নেমে আসে, জোছনার মিহি শাড়ি ছেড়ে।

মন্তব্য করুন


Link copied