নিউজ ডেস্ক: বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পায়, তখন এ দেশের ক্রিকেট ছিল ক্লাব কেন্দ্রিক। ৫০ ওভারে ঢাকা লিগই ছিল প্রধান আসর। এটুকু শুনে হয়ত ভাবছেন, তখন জাতীয় লিগ হতো না? হতো। ২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে সাকুল্যে ২টা ৪ দিনের জাতীয় লিগ হয়েছিল। সব মিলিয়ে টেস্ট খেলতে নামার আগে টাইগারদের ৪ দিনের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল খুব কম।
টেস্টের মেজাজ, ধরন, অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন সবই ছিল নতুন। টেস্টের করণীয় কাজগুলো সম্পর্কেও ধারণা ছিল কম। এরকম এক অনভিজ্ঞ ও দল টেস্ট খেলতে নেমে জাভাগাল শ্রীনাথ, জহির খান, অজিত আগারকার, সুনিল জোসি আর মুরালি কার্তিকের সাজানো ভারতের ধারালো বোলিং শক্তির বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে ক্রিকেট বিশ্বে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিল টিম বাংলাদেশ।
খোদ ভারতীয়রাও বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশ আর পারফরমেন্স দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু হায়! সেই দলই কি না দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯১ রানে অলআউট হয়ে ৯ উইকেটের ব্যবধানে শোচনীয়ভাবে হারলো।
অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দারুণ দায়িত্বপূর্ণ সেঞ্চুরি (১৪৫), হাবিবুল বাশারের সাবলীল উইলোবাজি আর অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের স্পিন জাদুর পর টাইগারদের শেষ পরিণতি দেখে আবার ততটাই আশা ভঙ্গের বেদনায় ‘নীল’ হয়ে পড়ে পুরো দেশ।
সবার মুখে একটাই কথা, প্রথম ইনিংসের অর্ধেক কিংবা ৬০ ভাগ রানও দ্বিতীয় ইনিংসে যদি করতে পারতো, তাহলে এমন এক তরফা ফল হতো না। অত বিশ্রীভাবে হারতেও হতো না।
প্রথম ইনিংসে যে তিনজন রান করেছেন, সেই বুলবুল, হাবিবুল বাশার সুমন এবং আকরাম খানের কেউ একজন দ্বিতীয় ইনিংসে রান করলেই হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো।
আজ ২৫ বছর পর জানা গেল, ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের এমন করুণ দশা নাও হতে পারতো। ভাবছেন, সেটা আবার কিভাবে? কি হলে টাইগারদের প্রথম টেস্টের শেষ পরিণতিটা ভিন্ন হতে পারতো?
মূলত, দ্বিতীয় ইনিংসে আম্পায়ারের ভুলে আউটের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ আকরাম খান। স্কোর কার্ডে লেখা আছে ভারতের বাঁ-হাতি স্পিনার সুনিল জোসির বলে মাত্র ১ রান করা আকরাম খান ক্লোজ ইন ফিল্ডার শিব সুন্দর দাসের হাতে ক্যাচ আউট হয়েছেন।
কিন্তু মুঠোফোন আলাপে খোদ আকরাম খান দিলেন নতুন তথ্য। দেশের ক্রিকেটের এ নামী তারকা ও সফল সেনাপতি জানালেন, ‘আমি সেকেন্ড ইনিংসে আউট ছিলাম না। ২০০ ভাগ নিশ্চিত হয়ে, এখতিয়ার নিয়ে বলছি আমি আউট ছিলাম না। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ আর সিলি মিড অনের মাঝামাঝি ভারতের ক্লোজ-ইন ফিল্ডার শিব সুন্দর দাস যে ক্যাচ লুফেছিলেন, সেটা ছিল ফার্স্ট বাউন্সে নেয়া।’
৯৭‘র আইসিসি ট্রফি বিজয়ী অধিনায়ক আকরাম খানের দাবি, ওই আউটের পর একবার মাত্র স্লো-মোশন রিপ্লে দেখানো হয়েছিল। এখনকার মত সিদ্ধান্ত রিভিউ করার বিধান থাকলে তিনি নির্ঘাত বেঁচে যেতেন। আকরাম ওই আউটের হাত থেকে বেঁচে সেঞ্চুরি করতেন, একশো-দেড়শো করে ভারতকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মিশনে অগ্রনী ভূমিকা রাখতেন, তা বলা হচ্ছে না। তবে এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসকে মানদণ্ড ধরলে, বলা যায় আকরাম খানের দলের ত্রাণকর্তা হওয়ার পূর্ব নজির কিন্তু ছিল।
৯৭‘র আইসিসি ট্রফির অঘোষিত কোয়ার্টারফাইনালে হল্যান্ডের বিপক্ষে চরম সংকটের মুহূর্তে আকরাম খানের ৬৭ রানের লড়াকু ইনিংসটিই বাংলাদেশকে খাদের কিনারা থেকে পৌঁছে দেয় জয়ের বন্দরে। সে জয়টা পাওয়া না হলে হয়তো বাংলাদেশের ১৯৯৯ বিশ্বকাপও খেলা হতো না, টেস্ট মর্যাদাও পাওয়া হতো না। তাই আকরাম দাঁড়িয়ে যেতে পারলে কিছু একটা করলেও করতে পারতেন, এমনটা বলা খুব বাড়াবাড়ি হবে না।
অভিষেক টেস্টে তার দলে থাকা ছিল একদম শতভাগ নিশ্চিত। ভারতের বিপক্ষে নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বেশ ভাল খেলেছেন আকরাম। তিনদিনের ম্যাচে সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি দুইই ছিল তার।
অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ৩৫ রানের বেশ সাবলীল ইনিংস খেলেন চট্টগ্রামের এ সূর্য সন্তান। জাগো নিউজের সাথে ব্যাংকক থেকে মুঠোফোনে কথা বলেন আকরাম খান। আলাপে শুরুতেই জানিয়ে দেন, ২৬ জুন টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির রজত জয়ন্তীর দিনে যে ঘটা করে অনুষ্ঠান হবে এবং অভিষেক টেস্ট খেলা দলকে যে সংবর্ধনা জানানো হবে (এর মধ্যে হয়ে গেছে) তিনি সে আনন্দযজ্ঞে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
বন্ধু আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে আকরাম বলে ওঠেন, ‘বুলবুলকে অনেক ধন্যবাদ। তার ইচ্ছে ও উদ্যোগেই অভিষেক টেস্ট স্কোয়াডকে সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণতঃ ক্রিকেটারদের সম্মান জানানো হয় কম। ক্রিকেটারদের মূল্যায়ন ও তাদের সাফল্যের গুণকীর্তন হয় কম। কিন্তু বুলবুলের উদ্যোগে অভিষেক টেস্টের ক্রিকেটাররা সন্মানিত হবে। মূল্যায়িত হতে যাচ্ছে; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমি ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবো না। আমার স্ত্রীকে নিয়ে থাইল্যান্ড এসেছি তার চেকআপ করাতে। চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া ছিল অনেক আগেই। ওদিকে আমার ভিসার মেয়াদও ফুরিয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে এ সময়টায়ই আমাকে স্ব-স্ত্রীক থাইল্যান্ড আসতে হয়েছে। আমার ফিরতে ফিরতে ২৯ থেকে ৩০ জুন লেগে যাবে। ততদিনে প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাবে।’
আকরামের আক্ষেপ, ‘অনুমান করতে পারি দারুন এক উৎসব মুখর পরিবেশ হবে। আমি ডেফিনেটলি মিস করবো।’ স্কোরকার্ড সাক্ষী দিচ্ছে অভিষেক টেস্টে অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ঠিক পরে ৫ নম্বর পজিসনে নেমে ৮৮ মিনিট উইকেটে থেকে স্বভাবসুলভ ব্যাটিং করে ৬৫ বলে ৩৫ রানের বেশ সাবলীল ইনিংস খেলেছিলেন আকরাম খান।
নিজের ব্যাটিংয়ের স্মৃতিচারণ করে আকরাম বলেন, ‘এখনো মনে আছে সুমন (হাবিবুল বাশার) আউট হওয়ার পর আমি উইকেটে যাই। বুলবুলের সাথে জুটি গড়ি। আমরা সম্ভবত ৬০-৭০ রানের (৬৫) একটি জুটি গড়েছিলাম। আমি নিজের মত করে শটস খেলছিলাম। বুলবুলকে বলছিলাম, বুলবুল আমি মারি। তুই অন্যদিক আগলে খেল।’
নিজের মত করে মেরে খেলার পথে অভিষেক টেস্টে আকরাম সবার অলক্ষ্যে একটি অন্যরকম কীর্তিও গড়ে রেখেছেন। জানেন সেটা কি? টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ছক্কাটি আকরাম খানের।
প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করা দল দ্বিতীয় ইনিংসে ৯১ রানে অলআউট হয় কি করে? চমৎকার শুরুর পর অভিষেক টেস্টের এমন করুন পরিণতি কেন?
আকরামের জবাব, ‘আসলে আমরা প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করার পর উৎসব আনন্দে মেতে উঠেছিলাম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কে কি পুরষ্কার পাবো, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। টেস্ট ক্রিকেট যে সেশনের খেলা, এক ইনিংস ভাল খেলে তার পরের অংশে সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা জরুরি, তা না হলে যে পতন, তা জানা ছিল না আমাদের। কি করে থাকবে? টেস্ট হলো সেশন বাই সেশনের খেলা। আমরা তো অভিষেক টেস্টের আগে বিদেশি দলের সাথে ৪ দিনের ম্যাচই খেলেছি খুব কম। বিদেশি দল বলতে এমসিসির সাথে হয়ত তিনদিনের ম্যাচ খেলতাম। তাই সেশন বাই সেশন ভাল খেলতে হয় কিভাবে তা জানাই ছিল না। সেজন্যই অভিষেক টেস্টে ধারাবাহিকতা ধরে রেখে খেলতে পারিনি।’
ক্রিকেট মাঠ থেকে বিদায় নিলেও ক্রিকেটের সাথেই জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম সফল অধিনায়ক আকরাম খান। এখন তিনি ক্রিকেট প্রশাসক। প্রথমে ছিলেন নির্বাচক, পরে প্রধান নির্বাচক ছিলেন বেশ কয়েক বছর। এরপর ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে বোর্ড পরিচালক পদেও নির্বাচিত হন। এখনো বোর্ড পরিচালক হিসেবেই বিসিবিতে আছেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া পরিবারের অন্যতম সদস্য আকরাম খান।
২ কন্যা সন্তানের জনক আকরাম। দুই মেয়েই পড়াশোনা করছে। বড় মেয়ে কানাডায় কমার্সে গ্র্যাজ্যুয়েশন শেষ করেছে। আর ছোট মেয়ে লন্ডনে পড়ছে মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন্সে।