ডেস্ক: সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে ছয়টি সড়ক রয়েছে পঞ্চগড়ে। এর একটি ৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ জাতীয় মহাসড়ক। বাকিগুলো জেলা মহাসড়ক। কোনো আঞ্চলিক সড়ক নেই। সব মিলিয়ে পঞ্চগড়ে সওজের সড়ক নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ১৮২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (এইচডিএম) সার্কেলের তথ্য বলছে, নেটওয়ার্কভুক্ত সড়কের ৮৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশই রয়েছে ভালো অবস্থায়। শতাংশের এ হিসাবে দেশে পঞ্চগড়ের চেয়ে বেশি ‘ভালো সড়ক’ আর কোনো জেলায় নেই। পঞ্চগড় সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরা বলছেন, গুণগত মানের নির্মাণকাজ, নিয়মিত ও সঠিকভাবে সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণ ভালো মানের সড়কের দিক দিয়ে পঞ্চগড়কে এগিয়ে রেখেছে।
বাংলাবান্ধা থেকে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় সীমান্ত পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ জাতীয় মহাসড়কটি (এন-৫) নির্মাণ হয় ২০০৯-১০ সালে। পরবর্তী সময়ে নিয়মিত ও সময়ভিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া মহাসড়কটিতে বড় ধরনের আর কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হয়নি বলে জানিয়েছেন সওজ পঞ্চগড়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড়ের ছয়টি সড়কের মধ্যে সবক’টিই ভালো অবস্থানে রয়েছে। সড়ক নেটওয়ার্ককে আরো ভালো অবস্থায় নিয়ে যেতে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।’
পঞ্চগড়ের পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের সড়ক অবকাঠামোও রয়েছে ভালো অবস্থায়। জেলার ৮০ দশমিক ১৩ শতাংশ সড়ক ভালো। অন্যদিকে ভালো সড়কের দিক দিয়ে পঞ্চগড়ের পরেই অবস্থান পদ্মাপারের জেলা ফরিদপুরের। এইচডিএমের হিসাবে ফরিদপুরের ৮৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ সড়ক ভালো। একইভাবে ৭৯ দশমিক ৯১ শতাংশ ও ৭৯ দশমিক ২ শতাংশ ভালো সড়ক রয়েছে যথাক্রমে শেরপুর ও রাজশাহী জেলায়।
সারা দেশে সওজের সড়ক নেটওয়ার্ক ১০টি জোনে বিভক্ত। এইচডিএমের তথ্য বলছে, ভালো সড়কের দিক দিয়ে উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও রাজশাহী—দুই জোনেরই সড়ক অবকাঠামো ভালো অবস্থায় রয়েছে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও বাদে রংপুর জোনের অন্য জেলাগুলোর মধ্যে বগুড়ার ৬৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, দিনাজপুরের ৭৩ দশমিক ১৩, গাইবান্ধার ৭৫ দশমিক ৯২, জয়পুরহাটের ৭৫ দশমিক ১৪, কুড়িগ্রামের ৭১ দশমিক ৪৭, লালমনিরহাটের ৬৬ দশমিক ৭১, নীলফামারীর ৭২ দশমিক ৮৩ ও রংপুরের ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ সড়ক রয়েছে ভালো অবস্থায়। সার্বিকভাবে সওজের রংপুর জোনের ৭০ শতাংশের বেশি সড়ক রয়েছে ভালো অবস্থায়। অন্যদিকে দেশের অন্য জেলাগুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি ভালো সড়ক রয়েছে মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জ, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটে।
রংপুর অঞ্চলের সড়ক অবকাঠামো ভালো হওয়ার জন্য এ অঞ্চলের মাটি বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন সওজের রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব উঁচু বাঁধের প্রয়োজন হয় না। এজন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তুলনামূলক সহজ। রংপুর জোনের সড়ক অবকাঠামো ভালো হওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ উন্নত মানের পাথর ব্যবহার। স্থানীয় স্থলবন্দরগুলো দিয়ে সহজেই ভারত থেকে উন্নতমানের পাথর আমদানি করা যায়। ঠিকাদাররা যেন উন্নয়নকাজে এসব উন্নতমানের পাথর ব্যবহার করেন তা আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। এর বাইরে রংপুর জোনের সড়ক উন্নয়নকাজে স্থানীয় ঠিকাদারদের বদলে দেশের স্বনামধন্য ঠিকাদারদের নিযুক্ত করে গুণগত মান বজায় রেখে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। সার্বিকভাবে এসব বিষয় সড়ক অবকাঠামোকে টেকসই করতে ভূমিকা রাখছে।
বিদ্যমান সড়কগুলো বাস্তব অবস্থা যাচাইয়ের জন্য প্রতি বছরই জরিপ করে সওজের এইচডিএম সার্কেল। অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বের করা হয় সড়কের ইন্টারন্যাশনাল রাফনেস ইনডেক্স (আইআরআই) ভ্যালু। জরিপ করা সড়কগুলোর মান পরীক্ষা করে শূন্য থেকে ১২ পর্যন্ত নম্বর দেয়া হয়। আইআরআই ভ্যালু অনুযায়ী, নম্বর যত কম, সড়ক তত ভালো। এইচডিএমের সর্বশেষ জরিপটি করা হয়েছে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। সওজের সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে জরিপ করা হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়ক।
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর ঠিক উল্টো পরিস্থিতি রয়েছে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের সড়ক অবকাঠামোগুলো। খারাপ সড়কের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে খাগড়াছড়ি। জেলার ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ সড়ক খারাপ। বিপরীতে ভালো সড়কের পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বান্দরবানে খারাপ সড়কের পরিমাণ ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর জেলাটিতে ভালো সড়ক আছে ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে রাঙ্গামাটি। জেলার ৪৬ দশমিক ৩১ শতাংশ সড়ক ভালো বলে উঠে এসেছে এইচডিএমের জরিপে। দেশের অন্য জেলাগুলোর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৩৪ দশমিক ১৭ শতাংশ, চাঁদপুরে ৩০ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩০ দশমিক ২৪ শতাংশ সড়ক রয়েছে খারাপ অবস্থায়।
দেশজুড়ে সওজের নেটওয়ার্কে থাকা সড়কের পরিমাণ সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে চার লেনের সড়কের পরিমাণ ৫০০ কিলোমিটার। আট আর ছয় লেনের সড়ক মোটে ৩৮ কিলোমিটার। গত জুনে প্রকাশিত এইচডিএম সার্কেলের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সওজের নেটওয়ার্কে থাকা ৩ হাজার ৬৪৭ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে খারাপ অবস্থায়। এর মধ্যে ৮৩৯ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা ‘খুবই খারাপ’। ‘খারাপ’ অবস্থায় রয়েছে ৯৫০ কিলোমিটার সড়ক। বেশ দুর্বল অবস্থায় রয়েছে আরো প্রায় ১ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার সড়ক। এসব সড়ক মেরামত করতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার চাহিদার কথা জানিয়েছে এইচডিএম।
দেশের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক অবকাঠামো খারাপ অবস্থায় থাকলেও সওজের প্রকৌশলীরা বলছেন, দেশের সড়ক অবকাঠামো ক্রমান্বয়ে ভালো অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সওজের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেন, সড়ক নির্মাণে আমরা উন্নতমানের বিটুমিন ব্যবহার শুরু করেছি। পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রীর মানের দিকেও আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। টেকসই মহাসড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নকশা ও নির্মাণশৈলীতেও আমরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার, তার সবই গ্রহণ করছি। এসবের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের সড়ক অবকাঠামোর মানে। খবর-বণিক বার্তা