আর্কাইভ  শনিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৪ ● ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নাশকতার আগে এক লাখ সিম যুক্ত হয় ঢাকার নেটওয়ার্কে       রংপুরে ১২ মামলায় গ্রেপ্তার ১৭৫       আহতরা যেই দলেরই হোক, চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার: প্রধানমন্ত্রী       ২৭শে জুলাই রংপুর বিভাগের আট জেলায় কারফিউ শিথিল       সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান বেরোবি প্রশাসনের      

 width=
 

নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২২, রাত ০৯:২৬

শেখ মাজেদুল হক

পরাধীন দেশের কুসংস্কার-কূপমন্ডুকতা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আর ধর্মীয় গোঁড়ামীতে আচ্ছন্ন সমাজে, অশিক্ষার অভিশাপে নিমজ্জিত স্ত্রী জাতিকে যিনি ‘চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া’ উঠার আহবান জানিয়েছিলেন তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে জন্ম রোকেয়ার। রোকেয়ার বাল্যনাম ছিল রোকেয়া খাতুন। বাড়ির সবাই ডাকতো ‘রুকু’ বলে। বাবার নাম জহিরউদ্দিন আবু আলী সাবের আর মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। ছয় ভাইবোনের সংসারে তার এক ভাই শৈশবেই মারা যান। দুই বোন করিমুন্নেসা ও হোমায়েরা এবং দুই ভাইয়ের নাম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের। মস্ত প্রাসাদে বাস, বাগানের গাছ গাছালি থেকে সারাদিন ধরে কত কত পাখির ডাক, বাগানের মধ্যে আবার মস্ত এক পুকুর, পরিচর্যার জন্য রয়েছে কত পরিচারিকার দল। কিন্তু এত ঐশ্বর্য আর স্নেহ-ভালবাসার মাঝেও রোকেয়া বড় হয়ে উঠেছেন পর্দা প্রথার কঠিন নিয়ম মেনেই। একে তো পর্দাপ্রথার দাপট, তার থেকেও কষ্টের লেখাপড়া শেখার উপর নিষেধাজ্ঞা।

রোকেয়ার পরিবারে মেয়েদের আরবি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল ঠিকই, কিন্তু বাংলা বা ইংরেজি পড়তে চাইলেই বিপদ! পরিবারের নিষেধ অমান্য করে গোপনে রোকেয়াকে বাংলা শিখিয়েছিলেন বোন করিমুন্নেসা। তিনি নিজেও লুকিয়ে মাটিতে দাগ কেটে কেটে বর্ণমালা শিখেছিলেন। আর রোকেয়াকে ইংরেজি শিক্ষাদান করেছিলেন বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের। রোকেয়ার বয়স যখন মাত্র ষোল বছর, আটত্রিশ বছর বয়স্ক বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। এমন অসম বয়সের বর-কনে হওয়া সত্ত্বেও এ বিয়ে রোকেয়ার জীবনে আশীর্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছিল।

পায়রাবন্দের উঁচু পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। বাইরের খোলা পৃথিবীর হাওয়া লাগল গায়ে। কত জায়গায় ঘুরলেন তিনি স্বামীর সঙ্গে, জীবনের কত বিচিত্র রূপ দেখা হল। সাখাওয়াতের সাহচর্যে ইংরেজি পড়া আর লেখা-দুইই খুব ভালভাবে রপ্ত হল রোকেয়ার। বড় ভাই ইব্রাহীম সাবেরের কাছে যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি, স্বামীর সহযোগিতা পেয়ে তার পূর্ণ বিকাশ লাভ করল। রোকেয়ার স্বপ্ন সাখাওয়াতের স্বপ্ন হয়ে এগিয়ে যেতে থাকল সমান তালে, সমান গতিতে।১৮৯৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি ‘বেগম সাখাওয়াত হোসেন’ নামে পরিচিত হন। তার স্বামী মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরিতে অর্থ জোগান। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে রোকেয়া সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন।

রোকেয়া মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিধবা হন। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯০৯ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। স্বামীর অকালমৃত্যুতে তার জীবন-সংগ্রামে নতুন অধ্যায় সূচনা হয়। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরের নিজ বাড়িতে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে মেয়েদের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন রোকেয়া। কিন্তু ১৯১০ সালে ওই সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার ফলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১০ নং অলিউল্লাহ লেনের ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে আবার গার্লস স্কুলটি চালু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় স্কুলটিতে ছাত্রী ছিল আটজন। চার বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। ১৯৩০ সালের মধ্যে এটি হাইস্কুলে পরিণত হয়।

১৯১২ সালে মা এবং ১৯১৩ সালে বাবাকে হারান বেগম রোকেয়া। উপলব্ধি করেন বাবা, স্বামী ও পুত্রের আশ্রয় ছাড়া যে নারীর নিরাপদ আশ্রয় ভূ-ভারতে নেই, সে বিষয়টি । কিন্তু রোকেয়া পিছু হটেন না। বাধার পর বাধা অতিক্রম করে দৃঢ়-সংকল্পে তিনি সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যেতে থাকেন।

সে সময় মেয়েরা শিক্ষালাভ করবেন, তাও আবার স্কুলে যেয়ে, এটা যেন কল্পনার বাইরে ছিলা। ওই সময় মেয়েদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ।তিনি নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার আদায়, নারীর ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন আমৃত্যু এবং একসময় তিনি সফল হয়েছেন।তিনি কখনও নারীবাদী সমাজ গঠনের কথা বলেননি। বরং তিনি বলেছেন নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার কথা। তিনি সবসময় বলতেন, ‘মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী ও আদর্শ নারী হিসাবে পরিচিত হইতে পারেন।’একই সঙ্গে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কখনও পুরুষদের ছোট করে দেখেননি। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে?’ তিনি মূলত নারী জাগরণের মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কারকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন। তার চাওয়া ছিল সমাজের উন্নয়ন ঘটাবে নারী-পুরুষ সমান তালে কাজ করার মাধ্যমে।

রোকেয়া শুধুমাত্র নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেননি, একাধারে তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। তিনি মেহনতি মানুষের কথা বলতেন, বৈষম্যের শিকার মানুষের কথা বলতেন। তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘চাষার দুঃখ’ প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে তিনি কৃষকদের অমানবিক দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি শুধু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বলেননি, বাস্তবেও তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯১৬ সালে বাঙালি মুসলিম নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে অসহায় নারীদের সহায়তা করা হতো বিভিন্নভাবে, বিধবা নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতো, অসহায় ছাত্রীদের পড়ার খচর দেওয়া হতো, দুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করতেন। নিজে জমিদার কন্যা হয়েও সারাজীবন কাটিয়েছেন খুব সাদামাটা ভাবে। কখনো বিলাসিতা করতেন না, নিজের সম্পত্তি ব্যয় করতেন সমাজ সেবামূলক কাজে।এই অসামান্য অবদানের জন্য বাঙালি জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। ২০০৪ সালে বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী জরিপের তালিকার ষষ্ঠ স্থানে উঠে আসে তার নাম। এছাড়া প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস স্মরণে দেশে সরকারিভাবে পালিত হয় রোকেয়া দিবস। এদিনে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এমনকি দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীদের সরকারিভাবে প্রতিবছর প্রদান করা হয় বেগম রোকেয়া পদক। এছাড়াও তার নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। ২০০৮ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরে স্থাপন করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই মহীয়সী নারীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। এ রকম আরও স্থাপনা আছে দেশজুড়ে।

রোকেয়া এ উপমহাদেশের নারী স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক। অন্ধকারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল সময়ে আলোর প্রতীক। আজ এ দেশ ও সমাজের যতটুকু উন্নতি হয়েছে, বিশ্বের দরবারে যতটুকু মান পেয়েছে এই দেশ, তা সম্ভব হয়েছে নারী ও পুরুষের যৌথ মেধায়, যৌথ প্রচেষ্টায়। আর এক্ষেত্রে নারীর ভূমিকার পেছনে বড় অবদান বেগম রোকেয়ার।

এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর নিজের জন্ম দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ৫২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে লোভ-লালসা, মোহ, খ্যাতি ইত্যাদি সকল কিছু থেকে মুক্ত থেকে শুধুই দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের উপর দাঁড়িয়ে কাজ করে গেছেন।বাঙালি জাতি আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের কারিগর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। শুধু স্মরণ করলেই হবে না, তার আদর্শ যাতে বাস্তবায়ন হয় সমাজে সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে। নারীকে নারী হিসেবে নয়, বিবেচনা করতে হবে মানুষ হিসেবে এবং মেহনতি মানুষদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় থাকতে হবে সর্বদা সোচ্চার, তবেই বাস্তবায়ন হবে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের দেশ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও  বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত ), মার্কেটিং বিভাগ।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।
Email: smh.mkt@brur.ac.bd 

মন্তব্য করুন


 

Link copied