নিউজ ডেস্ক: পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের প্রধান ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনার উল্টো সুর শোনা যাচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় ১৫ মাস পর এসে তিনি বলছেন, তাদের পতনের পেছনে আমেরিকা বা পশ্চিমা কোনো শক্তির সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে তিনি মনে করেন না। অথচ গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর থেকেই হাসিনা এবং তার সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতা-কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রকেই দোষারোপ করে আসছিলেন।
নিজেদের বিশ্বাসের এবং প্রচারিত সব ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’কে উড়িয়ে দিয়ে হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ‘ভালো ও স্থিতিশীল সম্পর্ক’ রয়েছে। তাই ‘ওয়াশিংটন বা অন্য কোনো বিদেশি শক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়াদিতে সরাসরি জড়িত’, এমন দাবি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
সিএনএন-নিউজ এইটিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনা আরও বলেন, তিনি স্বীকার করেন যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস পশ্চিমা বিশ্বে প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি পশ্চিমা বিশ্বে প্রভাবশালী শ্রেণির প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। হাসিনার মতে, তারা ড. ইউনূসের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক ভাবমূর্তিকে ভুলভাবে গণতান্ত্রিক যোগ্যতা হিসেবে দেখেছেন।
ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগের প্রধান আরও দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। হাসিনা বলেন, যদি পশ্চিমারা মনে করে ইউনূস তাদের বন্ধু, তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পরপরই আগস্টে ভারতের ইকোনমিক টাইমস তাকে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে, কারণ তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ চায়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে প্রায় দেড় হাজার মানুষ হত্যার মতো ঘটনা আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে ভূমিকা রাখলেও প্রায় ১৫ মাস ধরে হাসিনার অনুসারীরা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ই বিশ্বাস এবং প্রচার করে আসছিল। এমনকি সবশেষ গত ৮ নভেম্বর রাশিয়ান সংবাদমাধ্যম ‘আরটি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনার সরকারের বহুল বিতর্কিত মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও একই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান ইউএসএআইডি ও ক্লিনটন পরিবার জড়িত ছিল।
হাসিনার পতন যেভাবে
গত বছরের জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের দমনে মাঠে নামালে সহিংসতা শুরু হয়।
এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্নিগর্ভ হলে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাসিনার সরকার। একইভাবে লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের। তাদের উন্মত্ততায় রাজপথে বয়ে যায় রক্তের নদী। এক পর্যায়ে আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। তীব্র জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা আর টিকতে পারেননি। পালিয়ে যান ভারতে। তার আগে-পরে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-কর্মী। এমনকি পুলিশ-প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও গাঢাকা দেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান চলাকালে এক হাজার চারশ’র বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো সামরিক অস্ত্র ও শটগানের গুলিতে মারা যান। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। অনেকের দুই চোখ, কারো কারো এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ১১ হাজার সাতশর বেশি মানুষকে র্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, এই হত্যাকাণ্ডসহ দমন-পীড়নে সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এ বছরের জুলাইতে বিবিসিতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যেখানে শেখ হাসিনার কথোপকথনের একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন।
বিবিসির যাচাই করা ওই রেকর্ডিং অনুসারে, শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তারা (এসব বাহিনীর সদস্যরা) যেখানেই তাদের (আন্দোলনকারী) পাবে, তারা গুলি করবে।
ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ততার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্য আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের রায়ের দিন নির্ধারণ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামী ১৭ নভেম্বর (সোমবার)।