আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৭ জুন ২০২৫ ● ৩ আষাঢ় ১৪৩২
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৭ জুন ২০২৫
ইরানের ৩৭০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

ইরানের ৩৭০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

রাতভর ইরানি হামলায় ইসরাইলে নিহত ৪, আহত বহু

রাতভর ইরানি হামলায় ইসরাইলে নিহত ৪, আহত বহু

খামেনি তেহরানের বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন

খামেনি তেহরানের বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন

ইসরায়েলের হামলায় ইরানে অন্তত ৪০৬ জন নিহত, আহত ৬৫৪

ইসরায়েলের হামলায় ইরানে অন্তত ৪০৬ জন নিহত, আহত ৬৫৪

উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা অচল হলে এর দায়ভার কার?

বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪, দুপুর ১০:৫১

Advertisement

শেখ মাজেদুল হক
অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার-গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন গ্রেড প্রবর্তনের দাবীতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে সোমবার (১ জুলাই) থেকে দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত সর্বাত্মক কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে তাঁরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের সকল (৩৫ টি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক কর্মবিরতি।

কারণ, ১ জুলাই ,থেকে কার্যকর হয়েছে বিতর্কিত প্রত্যয় স্কিম। ১৩ মার্চ মাসে প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বিগত তিন মাস ধরে সারা বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ না করে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, মৌন মিছিল, গণস্বাক্ষর ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে সমাধানের চেষ্টা করেছে বলে কোন পত্রিকায় দেখিনি। তাহলে এর পেছনে কি কোন বিশেষ মহল আছে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কঠোর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন? এর যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে শিক্ষকেরা জানেন যে শিক্ষকতার কর্ম-ঘণ্টা আট ঘণ্টায় নির্ধারিত নয়, বরং তা চব্বিশ ঘণ্টা। কারণ শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনে এবং গবেষণাকাজ করেন। শিক্ষার্থীর যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো সময় নানা রকমে সাহায্য করেন। সেসব কাজগুলো শিক্ষক আনন্দের সঙ্গেই করেন, ঢোল পিটিয়ে তার জন্য বাহবা আকাঙ্ক্ষা করেন না। শুরু থেকেই যখন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় নি, তখনই যদি এই দাবিগুলো মেনে নেয়া হতো কিংবা মেনে নেয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করতো। তাহলে হয়তো আজ এমন সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে শিক্ষকদের যেতে হতো নাহ।

আসলেই প্রত্যয় কর্মসূচি বৈষম্যমূলক। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তো স্বায়ত্তশাসিত । যদি এই স্কিম এত ভালো হয় তবে সরকারের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এই স্কিমের আওতাভুক্ত নয় কেন! তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কে কেন টার্গেট করা হল। বর্তমান সরকার যখন দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কে সেশনজট মুক্ত, স্থিতিশীল সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ঠিক তখনই কেন বিশ্ববিদ্যালয় ১৬,০০০ মেধাবী শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেয়া হল। এটা উচ্চ শিক্ষা ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র ! লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কেন অনিশ্চয়তা র পথে ধাবিত করে হল। জে এস টি ২৪ টি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম কেন অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়া হল! কারা সরকারের সাথে মেধাবী শিক্ষকদের মুখোমুখি করে দিতে চায়? স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থার দরকার, স্মার্ট নাগরিক তৈরি করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , সংশ্লিষ্ট শিক্ষক দের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নাই। যে জাতি শিক্ষকদের যত বেশী সম্মানিত করেছে তারা ততো দ্রুত এগিয়ে গেছে। একিভাবে যে জাতি শিক্ষকদের অসম্মানিত করেছে, সমাজে তাঁদের অবস্থান খাটো করেছে, তারা ততো বেশী পিছিয়ে গিয়েছে, অসভ্য হয়েছে। সকল পর্যায়ে যোগ্য ও মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিন, তাঁদের সমাজে উঁচু অবস্থান দিন, দেশ ও জাতি এমনি বদলে যাবে।

এই চাপিয়ে দেয়া প্রত্যয় স্কিম শুধু বৈষম্যমূলক নয়, এটা খুবই অপরিপক্ব। বর্তমান পেনশন পদ্ধতিতে কোনো চাঁদা দিতে হয় না। আবার আছে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, যাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যায়। একজন অধ্যাপক যখন অবসরে যান, এককালীন যে প্রায় ৮১ লাখ টাকা আনুতোষিক বর্তমানে পাওয়া যায়, প্রত্যয়ে সেটাও থাকবে না। তাহলে কীভাবে সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, আমার কাছে বোধগম্য নয়। কর্মসূচি চালু করার আগে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল। ২০-৩০ বছর পরের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা উচিত। মোটকথা, কোনো হিসাব ও দূরদর্শী পর্যবেক্ষণ ছাড়াই চালু করা হয়েছে প্রত্যয়। বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। কর্মকর্তা রয়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি। কর্মচারীসহ সবমিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অথচ সরকারের অন্য চাকরিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের ক্ষেত্রে আগের নিয়মেই পেনশন ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। অন্যদিকে এটি যেহেতু সর্বজনীন পেনশন।তাহলে এটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়বে। অবসরকালীন নিশ্চয়তা একই রকম না থাকলে আগামীতে মেধাবীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন।

সরকারের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এই স্কিমের আওতাভুক্ত নয়। যে কারণে এই স্কিমকে কোনো অর্থেই সর্বজনীন বলতে নারাজ । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যুক্তি, এই পরিকল্পনা যদি এতই ভালো তাহলে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এর বাইরে থাকবে কেন? এ ছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অবসরকালে তাদের অভোগকৃত ছুটির একটি অংশ নগদায়ন বা টাকায় পরিণত করতে পারেন, যার সুযোগ প্রত্যয় পরিকল্পনায় নেই। পাশাপাশি বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর চাকরি করলেই একজন শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন প্রাপ্য হন, যা নতুন প্রত্যয় পরিকল্পনায় নেই। নতুন পরিকল্পনায় এই সময় ১০ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ কি খুব বেশি কিছু চেয়েছে? যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান না পেলে কোন যোগ্য মানুষ ঐ স্থানে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে না। এজন্যই প্রতিবছর শত শত মেধাবী শিক্ষক দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল দাবি তিনটি হলো:

0১) বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন (প্রত্যয় স্কিম) প্রত্যাহার,
0২) ২০১৫ সালের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি, এবং
0৩) শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন।

এগুলো কি খুব বেশি অযৌক্তিক দাবি? নিশ্চয়ই না! শিক্ষক তা এক মহান পেশা। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন তারা অধিকাংশ ই অনেক মেধাবী ও বিনয়ী মানুষ। একজন শিক্ষক হাজার টা বিসিএস ক্যাডার তৈরি করেছেন। মনে রাখতে হবে শিক্ষকবৃন্দ সরকারের চাকরি করেন, কিন্তু সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা আন্তর্জাতিক গবেষক ও স্কলার। শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা আমেরিকা, চীন, ভারতসহ সারা বিশ্বের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারদের সাথে। তাই শুধু সরকারের কর্মচারী না ভেবে যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা উচিৎ। যোগ্যদের যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা উচিৎ। আশা করি দ্রুত সকল সমস্যার সমাধান হবে এবং আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সেশনজটের ঝামেলায় পড়বে না।

শিক্ষকদের দাবিগুলো মেনে নেয়া হলে, শিক্ষার মানও উন্নত হবে। যোগ্য শিক্ষকদের ধরে রাখতে পারলে, দেশের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সম্ভব হবে। শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা এবং বেতন-ভাতা প্রদান করলে, শিক্ষাক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আসবে এবং শিক্ষার্থীরাও নির্ধারিত সময়ে তাদের শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করতে পারবে। শিক্ষার্থীরা যে সময় শিক্ষায় ব্যয় করার কথা, তা কর্মবিরতির কারণে নষ্ট হচ্ছে। এতে তাদের শিক্ষাজীবনের মেয়াদ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত শিক্ষকদের দাবিগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া। এজন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষক, প্রশাসন এবং সরকারের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা।

শিক্ষকরা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তাদের সাথে অন্যায় হলে, শিক্ষার গুণগত মানেও তার প্রভাব পড়বে। তাই, শিক্ষকদের প্রতি সম্মান এবং তাদের দাবি পূরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেশনজট থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা জরুরি। সরকারের গড়িমসি এবং শিক্ষকদের দাবির প্রতি উদাসীনতা শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগের প্রধান কারণ। শিক্ষকরা যদি তাদের ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলনে যেতে বাধ্য হন, তাহলে এর দায়ভার প্রশাসন এবং সরকারের উপর বর্তায়। সরকারের উচিত শিক্ষকদের সাথে দ্রুত আলোচনায় বসে সমাধানের পথ খোঁজা এবং শিক্ষার্থীদের সেশনজট থেকে মুক্তি দেয়া। এতে শুধু শিক্ষকদেরই নয়, বরং শিক্ষার্থীদেরও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।  

প্রত্যয় শিক্ষক সমাজের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনছে না। পত্রিকায় পড়লাম এবং টেলিভিশনেও দেখলাম, পেনশন কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য কথা বলছেন। প্রত্যয় নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, উচিত হবে অর্থ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পেনশন কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও বিষয়গুলো যারা বোঝেন, তাঁদের নিয়ে বহু-পক্ষীয় একটি বৈঠকের আয়োজন করা। তখন যদি একটা সমাধান বেরিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি স্বতন্ত্র পে-স্কেল ও সুপার-গ্রেড প্রদানসহ শিক্ষকদের জন্য প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা এখন সকল স্তরের জনসাধারণের দাবি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সেশনজট, একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ফলে বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার মান সমুন্নত রাখতে এবং মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসতে সময়ের সাথে সাথে সুযোগ সুবিধা অবশ্যই বাড়াতে হবে। অন্যথায় এ জাতি আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, শিল্প ও গবেষণায় পিছিয়ে পড়বে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, মার্কেটিং বিভাগ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।

Email: smh.mkt@brur.ac.bd

মন্তব্য করুন


Link copied