নিউজ ডেস্ক: সারা দেশে এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক। ফেনসিডিল, ইয়াবা, কোকেন কিংবা ক্রিস্টাল মেথ-আইস, কুশ, খাট, ডিওবিসহ সব ধরনের মাদকই মিলছে দেশজুড়ে। চাইলে মিলছে হোম ডেলিভারিও। মাদকের এ প্রবাহ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। সরকারিভাবে মাদকসেবীর সংখ্যা না থাকলেও বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) হিসেবে দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। পুরুষের পাশাপাশি দিন দিন নারীদের মধ্যেও বাড়ছে মাদকের প্রবণতা। অবৈধভাবে ভারত ও মিয়ানমার থেকে জল, স্থল ও আকাশ পথে আসছে এসব মাদক। ধরাও পড়ছে অনেকে। একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে, এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। গতকাল বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের মির্জাপুর তিন রাস্তা মোড়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৬০ কেজি গাঁজা ও ৭৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে। ২১ মার্চ রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর সঙ্গে জড়িত হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্বামী-স্ত্রীসহ চারজন মাদক ব্যবসায়ীকে।
২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কক্সবাজারের টেকনাফে কোস্ট গার্ড ও র্যাবের সমন্বয়ে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ১২টি মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ৯ লাখ ৬ হাজার ৪৭০টি ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ৬০ কেজি ৪০০ গ্রাম গাঁজা। এভাবে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক উদ্ধার হচ্ছে, ধরা পড়ছে বহনকারী। কিন্তু মাদকের প্রবাহ কমছে না। বরং ছাত্রছাত্রীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সূত্র জানায়, দেশে এ পর্যন্ত ২৫ ধরনের মাদক শনাক্ত হয়েছে। বছরে মাদকের পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসায়ী, বাহক ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে প্রায় ২ লাখ ব্যক্তি। প্রতি বছরই বাড়ছে এ সংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে দেদার ইয়াবা ঢুকছে। আসছে ভয়ংকর মাদক আইসও। বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান ও কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালী, বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলছেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন রুট দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইস প্রবেশ করছে। পাশাপাশি সাগর পথ ব্যবহার করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী ও চাঁদপুর দিয়েও ইয়াবা আসছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে নিয়মিতই প্রবেশ করছে ফেনসিডিল, ট্যাপেনটাডোল ও এসকাফ সিরাপ। এ ছাড়া অন্য মাদকও প্রবেশ করছে। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ গাঁজা ও ইয়াবা আসছে। তিনি আরও বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান সর্বদা পরিচালনা করা হচ্ছে। অল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা থেকে দেশের অসৎ লোকেরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মাদকের প্রবাহ ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় পুলিশ বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন ও অন্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে মাদক উদ্ধার করছে। বড় বড় চালানও ধরা পড়ছে। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মাদকব্যবসার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন লোক যোগ হচ্ছে। পুরোনো ব্যবসায়ীরা তো আছেনই। তারা নিত্যনতুন কৌশলে মাদক বহন ও বিক্রি করছেন, এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে আধুনিক মাদক নিয়ে আসছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিতই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মাদক জব্দ ও এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে। তবে দেশে যে পরিমাণ মাদক আছে সেই পরিমাণ মাদক উদ্ধার করতে পারছে না। মাদকের বাহক বা মাদকাসক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেও এর পেছনে রাঘববোয়াল, পৃষ্ঠপোষক বা মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।