নিউজ ডেস্ক: দুপুরের হালকা রোদে ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন বসে ছিলেন তার অসম্পূর্ণ ইটের ঘরের সামনে। কিডনির ব্যথা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিলেন তিনি।
গত বছর তিনি ভারতে নিজের কিডনি বিক্রি করেন সাড়ে তিন লাখ টাকায়। ভেবেছিলেন, এই টাকা পেয়ে তার পরিবার আর দারিদ্র্যে থাকবে না তিন সন্তানের জন্য বাড়ি বানাতে পারবেন। কিন্তু এখন সেই টাকা শেষ, বাড়িটা এখনো অসম্পূর্ণ, আর ব্যথা তাকে ভোগাচ্ছে।
এখন তিনি একটি কোল্ড স্টোরেজে দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু তার শরীর খারাপ হওয়ায় কাজ করাও কঠিন হয়ে গেছে। সফিরুদ্দিন বলেন, আমি কিডনি বেচে দিয়েছি আমার পরিবারের জন্য। আমি শুধু তাদের ভালো থাকার জন্যই এটা করেছি। কিডনি বিক্রির সময় বিষয়টি খুব বিপজ্জনক মনে হয়নি। দালালরা তাকে বলেছিল, এটি একটি সুযোগ, কোনো ভয় নেই। প্রথমে তিনি সন্দেহ করলেও শেষমেশ দারিদ্র্য তাকে রাজি করিয়ে নেয়।
দালালরা তাকে মেডিকেল ভিসায় ভারতে নিয়ে গিয়েছিল। সব ব্যবস্থা তারা করেছিল—ফ্লাইট, কাগজপত্র, এমনকি হাসপাতালও। ভারতে যাওয়ার পর দালালেরা তার পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। বাকি কাগজপত্র জাল করে তারা। তার পরিচয় বদলে দেওয়া হয়েছিল, আর তার কিডনি অজানা একজনের শরীরে স্থাপন করা হয়েছিল, যাকে তিনি কখনো দেখেনইনি। সফিরুদ্দিন বলেন, আমি জানি না, আমার কিডনি কে পেয়েছে। তারা আমাকে কিছু বলেনি।
ভারতে আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে অথবা সরকারের অনুমতি নিয়ে কিডনি দেওয়া যায়। কিন্তু দালালেরা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। তারা পারিবারিক সম্পর্ক, হাসপাতালের কাগজপত্র, এমনকি ডিএনএ টেস্ট পর্যন্ত জাল করে। মনিরুজ্জামান নামে একজন গবেষক বলেন, সাধারণত বিক্রেতার নাম বদলে দেওয়া হয় এবং আইনজীবীর কাছ থেকে নেওয়া নোটারি সনদ দিয়ে দেখানো হয় যে, তারা আত্মীয় সম্পর্কের। আত্মীয় সম্পর্ক ঠিক করতে জাল আইডি কার্ডও দেওয়া হয়।
সফিরুদ্দিনের মতো তার গ্রামের অনেকেই থেকে কিডনি বিক্রি করেছেন। বাইগুনি নামের গ্রামটিকে স্থানীয়রা “এক কিডনির গ্রাম” বলে ডাকেন। কালাই উপজেলার এই এলাকা কিডনি পাচারের বড় জায়গা। ২০২৩ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, এখানকার প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন।
কালাই বাংলাদেশের দরিদ্র উপজেলাগুলোর একটি। এই উপজেলার বেশির ভাগ কিডনি বিক্রেতা পুরুষের বয়স ৩০ বছরের আশেপাশে। তারা সহজে দ্রুত টাকা পাবেন, এমন কথা শুনে কিডনি বিক্রি করেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৩ শতাংশই দারিদ্র্যের কথা বলে কিডনি বিক্রি করেছেন। কিছু লোক ঋণ পরিশোধ, মাদকাসক্তি বা জুয়ার জন্য কিডনি বিক্রি করেছেন।
সফিরুদ্দিন বলেন, দালালেরা তার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তা আর কখনো ফেরত দেয়নি। অস্ত্রোপচারের পর যে ওষুধগুলো দরকার ছিল, সেগুলোও দেয়নি। তিনি বলেন, তারা আমার সব কিছু নিয়ে গেছে।
দালালেরা ভুক্তভোগীর অস্ত্রোপচারের পর তার পাসপোর্ট আর ওষুধের কাগজপত্র জব্দ করে রাখে, যেন কেউ বুঝতে না পারে তার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে। পরে কিডনিদাতারা আর চিকিৎসাও পান না। তারা দীর্ঘ অপেক্ষার সময় ও কঠোর আইন অতিক্রম করে দ্রুত কিডনি পেতে চান। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে ২০২৩ সালে মাত্র প্রায় ১৩ হাজার ৬০০ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছিল, যেখানে প্রতি বছর আনুমানিক দুই লাখ রোগী শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগে আক্রান্ত হন।
আল জাজিরা বাংলাদেশের অনেক কিডনি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে, যারা সবাই প্রায় একই গল্প বলেছে। আর তা হলো, দারিদ্র্যের কারণে তারা কিডনি বিক্রি করেছেন। এই ব্যবসার কারণ খুব সহজ: দারিদ্র্য কিডনি বিক্রেতা তৈরি করে, আর ধনী মানুষ দ্রুত কিডনি পেতে চায়, সেই সঙ্গে আইন কঠোর না থাকায় এই ব্যবসা থামছে না।
কালাই উপজেলার বিনাই গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী বিধবা জ্যোৎস্না বেগম তার দুই মেয়েকে বড় করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। ২০১২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি ঢাকায় গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতে যান। সেখানে বেলাল নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তারা বিয়ে করেন। ২০১৯ সালে দালালদের প্রলোভনে জ্যোৎস্না আর বেলাল দুজনই ভারতে কিডনি বিক্রি করেন।
জোৎস্না বলেন, প্রথমে দালালেরা তাকে পাঁচ লাখ টাকা দেবে বলেছিল, পরে বাড়িয়ে সাত লাখ বললেও শেষ পর্যন্ত শুধু তিন লাখ টাকা পেয়েছেন। তাদের কলকাতার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে অস্ত্রোপচার করা হয়। দালালেরা জাল কাগজপত্র বানিয়ে কিডনি বিক্রি করে। কাগজপত্রে কিডনিগ্রহীতাকে তার আত্মীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অথচ জ্যোৎস্না জানেনই না কে তার কিডনি পেয়েছেন।
দালালেরা তার পাসপোর্ট নিয়ে যায় আর অস্ত্রোপচারের পর পাসপোর্ট ফেরত দেয়নি। তিনি প্রায় দুই মাস ভারতে ছিলেন, তারপর ফিরে আসেন। দালালেরা টাকা দেওয়ার কথা বললেও কিছুই দেয়নি। আর বেলাল টাকা পাওয়ার পর জ্যোৎস্নাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে করেন। জ্যোৎস্না অনেক দিন ধরে ব্যথায় ভুগছেন এবং ওষুধ কেনার টাকা নেই। তিনি ভারী কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, বাঁচতে তো হবে, কিন্তু সবসময় তো ওষুধ লাগে।
অনেক সময় যারা কিডনি পাচারের শিকার হন, তারাই পরে এই অবৈধ কারবারের অংশ হয়ে যান। মোহাম্মদ সজল (ছদ্মনাম) ঢাকায় আগে ব্যবসা করতেন। তিনি ইভ্যালির মাধ্যমে প্রেশার কুকার, প্লাস্টিকের জিনিস, ব্লেন্ডার ইত্যাদি বিক্রি করতেন। ইভ্যালি বড় লাভের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ইভ্যালির ধস নামার পর সজল সব কিছু হারান — তার সঞ্চয় এবং ব্যবসা দুইই শেষ হয়ে যায়।
ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে এবং ঋণের চাপে ২০২২ সালে তিনি দিল্লির ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। দালালেরা তাকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা। তিনি বলেন, তারা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আল জাজিরা ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে বারবার যোগাযোগের পরও কোনো মন্তব্য করেনি।
সজল ভাবছিলেন, কিডনি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, সেটা যদি পেতে হয়, তাহলে তাকেও এই দালালদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এরপর কয়েক মাস তিনি দালাল হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের অনেক মানুষকে তিনি ভারতীয় হাসপাতালে কিডনি দিতে নিয়ে গেছেন। পরে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দালালদের সঙ্গে ঝামেলা হয়। তখন প্রাণের ভয়ে তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন।
তিনি বলেন, আমি এখন এই চক্রের বন্দুকের সামনে রয়েছি। চক্রটি এখনও সবার সামনেই কাজ করছে, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতের হাসপাতাল পর্যন্ত তাদের হাত রয়েছে। ডাক্তার, রোগী, আর দুই দেশের দালাল — সবাই এই ব্যবসায় জড়িত। এখন সজল ঢাকায় রাইড শেয়ারের চালক হিসেবে কাজ করেন। তিনি নিজের অতীত ভুলে যেতে চান, কিন্তু শরীরের আর মনের ক্ষত যে রয়ে গেছে। তিনি বলেন, কেউ শখ করে কিডনি দেয় না। এটি খুব সহজ হিসাব— যখন মানুষ খুব অসহায় হয়, তখনই এমন কাজ করে।
বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, এই আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার বন্ধ করতে তারা কাজ করছে। বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, পোশাক পরা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও কিডনি পাচার চক্রের খবর খুঁজে বের করতে মাঠে কাজ চলছে। তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক দালালসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কিডনি বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ছেন, আমরা তাদের ধরার চেষ্টা করছি।
অন্যদিকে, ভারতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কিছু ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করেছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দিল্লি পুলিশ বিজয়া রাজাকুমারী নামে ৫০ বছর বয়সী এক কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে জানা যায়, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ১৫ জন বাংলাদেশি রোগীর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গ্রেপ্তার এতই কম আর বিচ্ছিন্ন যে এতে কিডনি পাচারে আসলে তেমন কোনো বড় ধাক্কা লাগে না। এই ব্যবসার মূল কাঠামো ঠিকই চালু থাকে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভারতের সরকারের ওপর দুই দিক থেকে চাপ আছে — একদিকে আইন ঠিকভাবে চালানো, অন্যদিকে মেডিকেল ট্যুরিজম বা চিকিৎসা ভ্রমণ ব্যবসা বাড়ানো। ২০২৪ সালে এই খাত থেকে ভারতে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষক মনিরুজ্জামান বলেন, ভারত এখন আইন ও নৈতিকতার দিকটা ঠিকমতো দেখছে না। তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এই ব্যবসা থেকে আসা অর্থের দিকে। এজন্যই অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপন সহজেই চলছে।
ভারতের ১৯৯৪ সালের মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন অনুযায়ী, কিডনি প্রতিস্থাপন সাধারণত বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীর মতো কাছের আত্মীয়দের মধ্যেই করা যায়। আত্মীয় না হলে, সরকারের বিশেষ অনুমতি কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এর মূল উদ্দেশ্য, কেউ টাকার লোভে যেন কিডনি দিতে না পারেন।
কিন্তু দালালেরা এই নিয়ম সহজেই ফাঁকি দেয়। তারা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে মিথ্যা আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখায়। এই ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও নোটারির সনদ খুব দ্রুত ও কম খরচে বানানো যায়। মনিরুজ্জামান বলেন, এই জাল কাগজপত্র দিয়ে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয় এবং অনেক সময় সরকারি বোর্ড ভুল বুঝে অনুমতি দিয়ে দেয়।
ঢাকায় বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুর বলেন, এই জাল কাগজপত্র তৈরির সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি কেউ জড়িত নয় এবং বাংলাদেশ সব আইনি নিয়ম ঠিকমতো অনুসরণ করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিডনি পাচার বন্ধে কোনো তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে না।
দিল্লির পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় হাসপাতাল বোর্ড এই জাল কাগজ চিনতে পারে না, তাই অবৈধ প্রতিস্থাপন হয়। তিনি বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, অনেক সময় অনুমোদন বোর্ড বুঝতেই পারে না যে কাগজ ভুয়া।
কিন্তু মনিরুজ্জামান বলেন, অনেক হাসপাতাল ইচ্ছা করেই এসব ভুল দেখে না, কারণ কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়লে তাদের আয়ও বাড়ে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলো অনেক সময় ইচ্ছে করেই না দেখার ভান করে। বেশি প্রতিস্থাপন মানেই বেশি টাকা। যখন প্রতারণা ধরা পড়ে, তখন হাসপাতাল বলে কাগজপত্র ঠিক ছিল, তাই তাদের কোনো দায় নেই। এইভাবে এই কারবার চলতেই থাকে।
মিজানুর রহমান নামে বাংলাদেশের এক দালাল বলেন, দালালেরা অনেক সময় ভারতের ডাক্তার বা হাসপাতালের কমিটির লোকেদের ঘুষ দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের দালালেরা ভারতের দালালদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগে থাকে। ভারতের দালালেরাই ডাক্তার ঠিক করে দেয়। অনেক সময় ডাক্তাররাই এই টাকার বড় অংশ নিয়ে নেয়।
ভারতের অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে সংস্থার এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় হাসপাতালগুলো দালাল, দাতা এবং ধনী রোগীর চাপের মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, যদি হাসপাতাল বোর্ড রাজি না হয়, ধনী রোগীরা অনেক সময় উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করেন বা আদালতে যান। এই ঝামেলা এড়াতে হাসপাতালগুলো অনেক সময় অস্ত্রোপচার করে ফেলে।
মনিরুজ্জামান বলেন, দালালেরা খুব চালাক। যখন কোনো এলাকায় পুলিশের অভিযান বাড়ে, তখন তারা দ্রুত অন্য হাসপাতালে চলে যায়। তিনি বলেন, তারা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। কোথাও যদি অভিযান হয়, সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্য জায়গায় চলে যায়। বাংলাদেশের দালাল আর ভারতের দালাল মিলে একসঙ্গে কাজ করে এবং নতুন হাসপাতাল ঠিক করে ফেলে।
দালাল আর সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর জন্য এই কিডনি পাচার বড় ধরনের লাভের সুযোগ। কিডনি নিতে চাইলে অনেক সময় একজন রোগী ২২ থেকে ২৬ হাজার ডলার পর্যন্ত টাকা দেয়। কিন্তু যিনি কিডনি দেন, তিনি এই টাকার খুব সামান্য অংশই পান। দালাল মিজানুর রহমান বললেন, সাধারণত দাতারা তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পান।
বাকি টাকা দালাল, জাল কাগজ বানানো লোক আর যদি ডাক্তার জড়িত থাকে, তবে তাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। কিছু টাকা দাতাদের ভারত থাকা-খাওয়ার ক্ষেত্রেও খরচ হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতারণা আরও ভয়াবহ। অনেক সময় দালালেরা বাংলাদেশের দরিদ্র লোকেদের ভারতে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখায়, কিন্তু সেখানে নিয়ে জোর করে কিডনি দিতে বাধ্য করে।
অনেক সময় চাকরির আশায় যাওয়া লোকেদের হাসপাতালের বিছানায় নিয়ে অস্ত্রোপচার করে ফেলা হয়, অথচ তারা পুরো বিষয়টি বুঝে উঠতেই পারে না। যেমন গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতে দালালদের একটি চক্র অনেক বাংলাদেশিকে কাজের প্রলোভনে নিয়ে যায়, তাদের কিডনি নিয়ে খুব কম টাকা দিয়ে ফেলে রেখে যায়। গত বছর ঢাকায় তিনজন দালাল ধরা পড়েছিল, যারা অন্তত ১০ জনকে চাকরির কথা বলে দিল্লিতে পাচার করেছিল এবং তাদের দিয়ে জোর করে কিডনি নিয়ে গিয়েছিল।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরীফুল হাসান বলেন, অনেকে সত্যিই চরম দারিদ্র্যের কারণে কিডনি বিক্রি করেন, কিন্তু অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। ভারতে কোনো ধনী রোগীর কিডনি দরকার হলে দালালেরা বাংলাদেশের কোনো গরিব দাতা খুঁজে বের করে বা চাকরির লোভ দেখিয়ে কাউকে নিয়ে যায়, এই চক্র এভাবেই চলতে থাকে।
ভারতের কিডনি রোগীদের সহায়তা করা সংগঠন ‘কিডনি ওয়ারিয়রস ফাউন্ডেশনে’র প্রধান রঘুবংশী বলেন, ভারতে বৈধ দাতার অভাবই এই পাচার ব্যবসার বড় কারণ। তিনি বলেন, অত্যন্ত অসহায় রোগীরা তখন অবৈধপথে কিডনি খোঁজেন, আর এই সুযোগে গরিব মানুষেরা ফাঁদে পড়েন।
তিনি বলেন, ভারতের আইনি ব্যবস্থা কিডনি ব্যবসা ঠেকানোর জন্য করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে এই আইন শুধু পাচারটাকে লুকিয়ে চলার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি মনে করেন, যদি কিডনি পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত একটি নিয়ন্ত্রিত ও মানবিক পদ্ধতি তৈরি করা উচিত। এতে দাতাদের বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের পর নিয়মিত চিকিৎসা সহায়তা এবং ভবিষ্যতের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
আবার ফেরা যাক কালাই উপজেলার সফিরুদ্দিনের কাছে। তিনি এখন বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন। তার চলাফেরা বেশ ধীর। শরীরের শক্তিও অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, আমি ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। তিনি জানান, অনেক রাত তিনি ঘুমাতে পারেন না। তখন মনে পড়ে, দালালরা যেসব স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেগুলো কীভাবে ভেঙে গেছে।
তিনি জানেন না তার বাড়ির নির্মাণ কাজ কখন শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কি না। তিনি ভেবেছিলেন, কিডনি দিয়ে পাওয়া টাকা দিয়ে পরিবারকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দেবেন। কিন্তু এখন তার সন্তানেরা শুধু একজন অসুস্থ বাবাকে পেয়েছে। আর তার মনে কেবল একটাই বেদনা– আর তা হলো প্রতারণা। তিনি বলেন, ওরা আমার কিডনি নিয়ে পালিয়ে গেছে।