নিউজ ডেস্ক: চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনেই বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে। একাধিক গ্রুপে বিভক্ত অসংখ্য প্রার্থী তৎপর। মনোনয়ন লড়াইয়ে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। সবকটি আসনেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সবকটি আসনে এককপ্রার্থী চূড়ান্ত করেই জোর কদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পাওয়ায় প্রচারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে দলটি। ফলে বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনের মধ্যে দুটিই দলটির চ্যালেঞ্জ হবে জামায়াত।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জানান, নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা নিয়ে দ্বিধা কেটে যাওয়ায় সারা দেশের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও প্রচার-প্রচারণায় আগের চেয়ে গতি বাড়িয়েছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বেশ তৎপর। এলাকায় নানা কর্মসূচি পালন করছেন তারা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও অংশ নিচ্ছেন। নিজ নিজ দলের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলটির ৩১ দফার প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অন্যদিকে তাদের অনুসারীরাও সরব সামাজিকমাধ্যমে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনেই বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, নিত্যনতুন সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এসব কারণে আসনভিত্তিক নেতাকর্মীদের মধ্যে বড় ধরনের বিভক্তি দেখা দিতে পারে, যা আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জন্য দলীয় একটি কমন নির্দেশনা থাকা উচিত।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনেই জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করায় এককপ্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
এদিকে সদ্য আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলেও নির্বাচনি তৎপরতা শুরু হয়নি নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। এখনো ঠিক হয়নি সম্ভাব্য প্রার্থী। অন্যদিকে কমিটি থাকলেও নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড নেই গণঅধিকার পরিষদে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ)
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তৎপরতা শুরু করেছেন। ধানের শীষের টিকিট পেতে তিন নেতা এখন ব্যস্ত জনসংযোগে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। প্রচার চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ায় এ সংসদীয় আসনের রাজনীতি এরই মধ্যে জমে উঠেছে। দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। পাড়া-মহল্লায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছেÑকে পাচ্ছেন ধানের শীষের টিকিট; অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া না অন্য কেউ।
এবার জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ আসন থেকে বিএনপির অন্তত তিনজন প্রার্থীর কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন-বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও তিনবারের সাবেক এমপি অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত ও বিএনপি নেতা বেলাল-ই-বাকী ইদ্রিসী।
বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, শিবগঞ্জ বিএনপির ঘাঁটি। এ আসনে দলটির প্রার্থী কে হবেন, তা প্রায় চূড়ান্ত। তাই দলটি অনেকটা নির্ভার। জানা গেছে, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি অধ্যাপক শাহজাহান মিয়াই হবেন বিএনপির প্রার্থী। তবে সৈয়দ শাহীন এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন।
প্রার্থিতার বিষয়ে শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে দলমতনির্বিশেষে সবার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। শিবগঞ্জ বিএনপির দুর্গ। মনোনয়ন পেলে এ আসনে অতীতের মতো আমি আবারও জয়ী হব বলে আশাবাদী।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ আসনের প্রার্থী হিসেবে ড. কেরামত আলীর নাম ঘোষণা করেছে। রাজশাহী মহানগর জামায়াতের আমির কেরামত আলী দুবার শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিও জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। দলের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাওয়ায় আশাবাদী জামায়াত নেতারা।
আসনটিতে বিএনপি থেকে শাহজাহান মিঞা মনোনয়ন পেলে জামায়াতের প্রার্থী কেরামত আলীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। কারণ হিসেবে জানা গেছে, কেরামত আলী দুবার উপজেলা চেয়ারম্যান এবং শাহজাহান মিঞা তিনবার এমপি থাকলেও দুজনের ক্লিন ইমেজ রয়েছে এলাকায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট)
নাচোল, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাটÑএই তিন উপজেলা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন। বরাবরই আসনটিতে বিএনপির ভোটব্যাংক শক্তিশালী। ৯১ থেকে এ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কোনো নির্বাচনেই দলটিকে নিরাশ করেননি ভোটাররা। নিরাপদ আসন বলেই স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতার চোখ এখানে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সারা দেশে মাত্র সাতটি আসনে জয়লাভ করে দলটি। সেই নির্বাচনেও এই আসনে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপি থেকে। এ কারণে আসনটিতে জামায়াতে ইসলামীর চ্যালেঞ্জ ধানের শীষের ভোট ব্যাংক।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই আসনে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন বিএনপির নেতা সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন। প্রয়াত মঞ্জুর হোসেন শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের কারচুপির ভোটে আওয়ামী লীগ এই আসনে বিজয়ী হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার বিএনপির দখলে যায় এই আসন। সারা দেশে রাতের ভোট ডাকাতির সময়েও আসনটিতে এমপি হন কেন্দ্রীয় বিএনপির শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম।
বর্তমানে আসনটিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বেসামাল বিএনপি। বিএনপি সমৃদ্ধ ভোট ব্যাংক থাকলেও ঐক্যের ঘাটতি কাল হতে পারে দলটির। আমিনুল ইসলাম ছাড়াও আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম তুহিন, রহনপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা তারিক আহম্মেদ ও মহিলা দলের নেত্রী মাসউদা আফরোজ হক (শুচি)।
বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবও কম নয়। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী মীম ওবাইদুল্লাহ এমপি হন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী হবেন ড. মিজানুর রহমান। তবে এ আসনে বিগত দিনের তুলনায় জামায়াতে ইসলামীর ভোট ও জনপ্রিয়তা দুটোই বেড়েছেÑএমনটাই দাবি দলটির নেতাকর্মীদের।
এই আসনে বিএনপি নেত্রী মাসউদা আফরোজও তৃণমূল থেকে হাইকমান্ড পর্যন্ত জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি প্রার্থী হলে ভোটের মাঠে ভালো করবেন বলে দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে মাসউদা আফরোজ বলেন, আমার তিন উপজেলার দলের নির্যাতিত, মামলা-হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। স্থানীয় তৃণমূল বিএনপি ও কেন্দ্রের নির্দেশা অনুযায়ী কাজ করছি। এক্ষেত্রে দল অবশ্যই বিবেচনা করবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর)
রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর থেকে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। টানা কয়েকটি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে এখানে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজনীতিতে দলটির শেকড় কতটা গভীরে তা প্রমাণ করেছে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনি ফল। তবে বর্তমানে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে।
এদিকে এই আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনুর রশীদের মতামত ও তার অনুসারীদের না নিয়েই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে হারুনুর রশীদের প্রায় দুই দশকের আধিপত্যের অবসান ঘটে। সব মিলিয়ে এ আসনে বিএনপির এখন তিনটি পক্ষ। অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিএনপির সেই ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। দলের ভেতরে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, একাধিক গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এবং কিছু নেতার ‘নিজস্ব বলয়’ গড়ে তোলার প্রবণতা জটিল করে তুলেছে বিএনপির রাজনীতিকে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনুর রশীদ। তিনি ছাড়াও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম (চাইনিজ রফিক) ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ মনোনয়ন চাইবেন। তারা প্রত্যেকেই নানাভাবে গণসংযোগ ও লবিং তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে এই আসনে জয়ী হন জামায়াতের লতিফুর রহমান। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল। জামায়াত ও বিএনপির কেন্দ্রীয় দুই হেভিওয়েট নেতার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথা বলছেন সাধারণ ভোটাররা। বিএনপি নেতা হারুনুর রশীদ মনোনয়ন না পেলে ফলাফল জামায়াতের পক্ষে যাওয়ার কথা বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ নূরুল ইসলাম বুলবুল জামায়াতের এককপ্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন মাঠে রয়েছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তার ইমেজ বেড়েছে বিগত দিনের চেয়ে কয়েকগুণ। বুলবুল যেভাবে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে গণসংযোগ করেছেন এবং অসহায়দের কল্যাণে হাত বাড়িয়েছেন এর প্রতিদান দিতে চান ভোটাররা।
জানতে চাইলে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে। সাধারণ মানুষ বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন দেখতে চায়। জামায়াতে ইসলামী একটি গণতান্ত্রিক দল। জামায়াত মানুষকে নিয়ে কাজ করে। তৃণমূল পর্যন্ত জামায়াতের সংগঠন রয়েছে। আগামী নির্বাচনে জনগণ দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে রায় দেবে।
মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দলের প্রতি আমার ত্যাগ রয়েছে, কঠিন সময়ে দলের দায়িত্ব নিয়ে পালন করে যাচ্ছি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই-সংগ্রামে রাজপথে ছিলাম। দায়িত্ব নিয়ে দলকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি নিঃস্বার্থভাবে। অবদান বিবেচনায় দল নিশ্চয়ই আমাকে অগ্রাধিকার দেবে।’
বিএনপির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘আমরা মনে করি জনগণ নতুন নেতৃত্ব চায়। জনগণের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেই বিবেচনায় দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে আশাবাদী।’