স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০ শিক্ষার্থী প্রাণ রক্ষা করে নিজের জীবন উৎসর্গকারী নিহত সাহসী শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধাঞ্জালি জ্ঞাপন করেছেন নীলফামারী জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন।
বুধবার(২৩ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ মরহুম শিক্ষিকার সমাধিস্থলে পৃথকভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন
নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান ও
পুলিশ সুপার এ.এফ.এম তারিক হোসেন খান।
এসময় মরহুমা শিক্ষিকার স্বামী মনছুর আলী হেলাল, দুই সন্তান আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী, জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন, জলঢাকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) আরজু মোঃ সাজ্জাদ হোসেনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। এরআগে সমাধিস্থল জিয়ারত, একমিনিট নিরবতা পালন ও শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে মরহুমের রুহের মাগফিরাতে দোয়া করেন তারা।
জানা যায়, জলঢাকার বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগামী ২৮ জুলাই। ওই সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা ছিল শিক্ষক মেহেরিনের। প্রতিষ্ঠানটির এ্যাডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই তিনি লাশ হয়ে ফিরলেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, মরহুম মোহিতুর রহমান চৌধুরী ও ছাবেরা চৌধুরী দম্পতির বড় সন্তান মেহেরিন চৌধুরী। তারা দুই ভাই ও দুই বোন। সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এর মা মরহুম জাহানারা খাতুন ও মাহেরিনের দাদী মরহুম রওশনারা বেগম ছিলেন আপন দুই বোন। তার দাদা মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরী ছিলেন এলাকার সুনামধন্য জমিদার। মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরীর পিতা মাহফুজার রহমান চৌধুরী বগুলাগাড়ী স্কুলটি নির্মাণ করেছিলেন ১৮১৯ সালে। ১৯৭০ সালে তা বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ নামে স্থাপিত করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী।
শিক্ষাজীবন শেষে মেহেরিন ২০০২ সালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৮ সালে শরীয়তপুর নড়িয়া উপজেলার চর আত্রাই গ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মনছুর হেলালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের রয়েছে দুই ছেলে সন্তান। এর মধ্যে বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও-লেভেল শেষ করেছে। আর ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী ও-লেভেল পরীক্ষা দেবে। মেহেরিনের বাবা মোহিতুর রহমান চৌধুরী ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ও মা ছাবেরা চৌধুরী ২০২০ সালের ৩০ জুন মারা যান।
সূত্র আরো জানায়, মেহেরীনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ৬ জুন। তিনি ১৯৯৫ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন।
মাহেরীন চৌধুরী শিক্ষকতার চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশী সময় পার করেছে নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর চলে যান ঢাকায়। যোগদান করেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর(৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর) সিনিয়র শিক্ষিকা ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন।
বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মহুবর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল এডহক কমিটির সভাপতি হন মেহেরিন। তিনি ২২ জুন প্রতিষ্ঠানে এসে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের দিকনির্দেশনা দেন। ২৮ জুলাই অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সোমবার (২১ জুলাই) বিমান বিধ্বস্থ হওয়ার আগে দুপুর ১২টার দিকে মুঠোফোনে আমার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়।
উল্লেখ যে, মঙ্গলবার(২২ জুলাই) বিকাল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে মাহেরিন চৌধুরীকে দাফন করা হয়। এর আগে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গজল আজম জামে মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত, সোমবার(২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হয়ে আসে মাহেরিন। সামান্য আঘাতও পায়। কিন্তু ভিতরে আটকা পড়ে থাকা অন্য শিক্ষার্থীদের টানে, তাদের উদ্ধারে তিনি ভিতরে ঢুকে পড়েন। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনকে আগুন থেকে উদ্ধার করেন মাহেরিন চৌধুরী। উদ্ধারে সময় তিনি দগ্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।