নিউজ ডেস্ক: গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনের এদিনে (২৬ জুলাই) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
হাসপাতালে উপস্থিত সমন্বয়কদের স্বজন ও চিকিৎসকরা জানান, একদল ব্যক্তি সাদা পোশাকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতাল থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যায়। পরে রাতে তিনজনকে হেফাজতে নেওয়ার কথা স্বীকার করে ডিবি। ডিবি জানায়, নিরাপত্তার স্বার্থেই তিন সমন্বয়ককে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
সহিংসতার বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হবে।
পরে রাতে বিষয়টি নিয়ে ধানমণ্ডিতে নিজ বাসায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, তিন সমন্বয়ক নিজেদের অনিরাপদ মনে করছিলেন। সমন্বয়করা মনে করছিলেন, তাঁদের যাঁরা বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁদের কেউ কেউ থ্রেট (হুমকি) করছে। তাঁদের নিরাপত্তার জন্যই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার যে, কারা তাদের হুমকি দিচ্ছে।
এদিকে দেশে প্রতিদিনই পর্যায়ক্রমে কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানো হচ্ছিল। জনজীবনও ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাজধানীতে কারফিউ শিথিল ছিল। ছুটির দিনে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক ছিল।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে এলে কারফিউ তুলে নেওয়া হবে।’
এদিনও নতুন করে দেশের কোথাও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে এদিন আগের আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বর্তমান বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই শিক্ষার্থীসহ আরো চারজনের মৃত্যু হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ, সংঘাত, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে এদিনও সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে চলে গ্রেপ্তার অভিযান।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) বলছে, ২৫ জুলাই রাত থেকে ২৬ জুলাই দুপুর পর্যন্ত ৭৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয় ২০৭ জনকে। ১৭ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত ১০ দিনে সারা দেশে মোট ছয় হাজার ২৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিন ঢাকার রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে হওয়া সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবন পরিদর্শনে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, তাঁর যে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের অনেকে নিজেকে ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তিনি শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেননি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের দিকেই যেন তাদের বেশি ক্ষোভ। আমার একটা কথা নিয়ে কত দিন প্রতিবাদ করল, কী কথা বলেছিলাম আমি? আমার কথাটাকে বিকৃত করা হয়েছিল। তাদের স্লোগানটা কী? ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।’
এদিন বিকেলে আন্দোলনে আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি চিকিৎসাধীনদের খোঁজখবর নেন এবং আহতদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা সহিংসতা চালিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিচার হবে বলে জানান তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, যারা সহিংসতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে।
শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আমরা বরাবরই শিক্ষার্থীদের দাবি সমর্থন করে আসছি।’
আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত রোকেয়া হল ও স্যার এ এফ রহমান হল পরিদর্শন করেন তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অন্তত ৩০০ কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হবে না জানিয়ে সাবেক উপাচার্য আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর হলে হলে নিয়মিত ছাত্ররাই যাতে রুম বরাদ্দ পায় তা নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে এদিন এক আলোচনাসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার সময় বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের আইডি হ্যাক করে ভুল বার্তা পোস্ট করা হয়েছে। এর আগে ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো জানিয়েছিলেন, তাঁর নামে এক্সে একটি ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। ইতালি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে আন্দোলনসংক্রান্ত কিছু ছবি ও বার্তা শেয়ার করা হয়।
এদিন এক বিবৃতিতে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠনের ডাক দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোট, বাম-ডান সব রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক ও সব ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পরিবারকে এদিন সাড়ে সাত লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে জানায়, ভিন্নমত ও দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অপরাধ নয়, সাংবিধানিক অধিকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা চলাকালে প্রতিটি প্রাণহানির ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।