নিউজ ডেস্ক: আটটি অঙ্গীকারনামা ও ৮৪টি প্রস্তাবনা উল্লেখ করে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তাবনা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গতকাল পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ওই অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদের সুপারিশ ও প্রস্তাবনাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। আলোচ্য সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই সনদের বৈধতা বা কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। ২৪-এর গণ অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে দেওয়া হবে সাংবিধানিক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জুলাই সনদে।
খসড়া সনদের ১০টি প্রস্তাবে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্টের মাধ্যমে আপত্তি জানিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ত্রয়োদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৫৮এর গ (২) প্রস্তাবের বিপরীতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সনদের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান নিয়ে বলা আছে - প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না। এ বিষয়ে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট, ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট আপত্তি জানিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাছাই কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এর গঠন প্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে মতামত দিয়েছে বিএনপি। নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতির যে প্রস্তাব রয়েছে, সে বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি সমমনা রাজনৈতিক দল। উচ্চকক্ষে ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী রাখার প্রস্তাবেও নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি ও এনডিএম। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্বের দুটি বিষয়ে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি দিয়েছে। এই দুটি বিষয় হলো- বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন না। বর্তমানে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এই দুটি পদে নিয়োগ হয়। সনদের প্রস্তাবে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্মকমিশনে নিয়োগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ, দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের প্রস্তাবনায়ও নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। জুলাই সনদের প্রস্তাবনায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাছাই কমিটি করে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের বিপক্ষে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো খসড়া সনদে বিদ্যমান সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অংশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতির উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি উল্লেখ রয়েছে। বিধানটি প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন।
সনদের প্রস্তাবনায় বলা আছে, বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকবে, যেটির নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং ১০০ সদস্যের গঠিত হবে। এ বিষয়ে সিপিবি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি ও এনডিএম। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময় একই সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। তালিকায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী রাখার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি, এনডিএম।
খসড়া সনদে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করার বিধান রয়েছে; সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠন করা হবে; বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হবে; প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনারদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে। আইনের দ্বারা গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করা হবে। সংবিধানের অধীনে দেশে একজন ন্যায়পাল থাকবেন; গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন; পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ এবং পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে স্বাধীন ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে।
গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদ প্রস্তাবনার খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি জানায়। ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। পরে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে সরকার চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। কমিশন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা আলোচনা করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। গতকাল এই খসড়াটিই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। আগামী সপ্তাহে এ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। ১৫ সেপ্টেম্বর কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।