উত্তর বাংলা ডেস্ক: বাবা আদম মসজিদ মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দরগাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত। এটি একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন মসজিদ। এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৪৮৩ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে। এ মসজিদে এখনও নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা হয়। এ মসজিদের চত্বরেই রইয়েছে বাবা আদম (রহ.) -এর মাজার। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে।
১০৯৯ সালে বাবা আদম (রহ.) সৌদি আরবের মক্কা নগর থেকে কিছুটা দূরের শহর তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কিশোর বয়স থেকেই আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ লক্ষ্যে তিনি বড় পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর কাছে দীক্ষা নিতে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে চলে আসেন। এরপর তিনি আরব থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে আসেন।
তখন বাংলায় সেন শাসন আমল চলছিল। সেরকম সময়ে ১১৭৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম। তখন এ এলাকাটি ছিল বল্লাল সেনের অধীনে।
জনশ্রুতি আছে যে, বল্লাল সেন ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী এক শাসক। তিনি তার এলাকায় মসজিদে আজান দেওয়া এবং গরু জবাই করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বাবা আদম এসে সেই এলাকায় আবার গরু-মহিষ জবাই দিতে শুরু করলেন এবং মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়া শুরু করলেন। ফলে বল্লাল সেন আর বাবা আদমের মাঝে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে দেখা দিল। সেই যুদ্ধে বল্লাল সেনের হাতে শহীদ হন বাবা আদম।
যুদ্ধে পরাজিত হলেও ভাগ্যক্রমে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার কারণে এলাকাটিতে মুসলিমদের কর্তৃত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই জনশ্রুতিগুলোর অধিকাংশই ঐতিহাসিকভাবেই মিথ্যা প্রমাণিত। কারণ বল্লাল সেনের পরও তার কয়েক প্রজন্মের হাতে সেই এলাকার শাসনভার অর্পিত ছিল, যা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। বাবা আদমের বিভিন্ন অবদানের জন্য তার মৃত্যুর প্রায় ৩০০ বছর পরে তার কবরের পাশে হিজরি ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এ মসজিদটি নির্মাণ করতে প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল। সুলতান ফতেহ শাহর শাসন আমলে মালিক কাফুর এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। যদিও বাবা আদম নামে সত্যিই কেউ ছিলেন কি না তা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকই সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর কারণ মসজিদটির শিলালিপিগুলোতে সেই আমলের অনেকের নাম থাকলেও বাবা আদমের নাম নেই।
এমনকি কোনো মাজারেরও উল্লেখ নেই সেসব শিলালিপিতে। সেখানে মসজিদটির নাম লেখা রয়েছে ‘জামে মসজিদ’ হিসেবে। মসজিদটির ছাদে একই আকৃতির অনতিউচ্চ ৬টি গম্বুজ রয়েছে। এর ভিত্তি এলাকার দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট এবং প্রস্থ ৩৬ ফুট। এর দেয়াল পুরটাই ইট এবং সুরকি দ্বারা নির্মিত। দেয়ালগুলো ৪ ফুট প্রশস্থ। ইটের আকার ৫ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত।
ইটগুলো লাল পোড়ামাটির তৈরি। এর সম্মুখে তিনটি খিলানের মতো প্রবেশ করার পথ আছে। খিলানগুলোর শীর্ষদেশে মনোরম কারুকাজ আছে। এখানে ঝুলন্ত শিকল ও ঘণ্টার অলংকরণ দেখা যায়। এ তিনটি পথের মাঝের পথটি এখন ব্যবহৃত হয়। মসজিদটিতে কোনো বারান্দা নেই। মসজিদটিতে মোট ছয়টি কাতারের ব্যবস্থা আছে। মসজিদটিতে নিয়মিত জামায়াতে নামাজ হয়ে থাকে বলে স্থান সঙ্কুলান হয় না।
তাই সামনের প্রাঙ্গণে কংক্রিট ঢালাই করে আরও সাতটি কাতারের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান তৈরি করা হয়েছে। মসজিদের দুপাশে জানালা নেই। ফলে রৌদ্রজ্জ্বল দিনেও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে মসজিদটি। মসজিদটি দেখতে অনেকটাই সুরক্ষিত দুর্গের মতো। এর কারণ সম্ভবত যাতে ইবাদতে মশগুল থাকা অবস্থায় মুসলমাররা যাতে কারও হামলা বা আক্রমণের শিকার না হোন। মসজিদটি থেকে কয়েক গজ আগেই বাবা আদমের মাজার। মাজারটি ২৫ ফুট বাহুবিশিষ্ট বর্গাকার আয়তনের। মাজারটির মঞ্চ ইটের তৈরি।
মসজিদটির ভেতরের পশ্চিম দেয়ালের দিকে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার অবতল মেহরাব আছে। মসজিদের চার কোণায় চারটি মিনার আছে। এ মিনারগুলোতে অলঙ্করণের কাজ আছে। পূর্ব দেয়ালে আরবি লিপির একটি শিলাফলকও চোখে পড়ে। এছাড়াও মসজিদটির দেয়ালে লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা, ঝুলন্ত প্রদীপ, শিকল, গোলাপ ফুল ইত্যাদির অত্যন্ত সুন্দর পোড়ামাটির নকশা আছে।
ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার মসজিদটি সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পরবর্তিতে তা সেই কাজ আর তেমন আগায়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিতে লোহার তৈরি সীমানা বেড়া দেয়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ থেকে এই বাবা আদম মসজিদের ছবি সংবলিত একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল।