নিউজ ডেস্ক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দিন আম্মারের আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে শাখা জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। গত সোমবার রাতে ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল আলীম ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মাদ আমীরুল ইসলাম বিবৃতিতে এ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি রাকসুর জিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে অশালীন ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। পাশাপাশি যখন-তখন বিভিন্ন দপ্তরে তালা লাগিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণের মাধ্যমে তিনি পুরো ক্যাম্পাসে ভীতিকর ও নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বিবৃতিতে শিক্ষকরা বলেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি হত্যার ঘটনায় আমরা শিক্ষকরা যেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছি, তেমনি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থানকারী ফ্যাসিবাদীদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছি। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট– সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকে তারা স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের সঙ্গে তুলনা করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। অধ্যাদেশ অনুযায়ী ডিন, সিন্ডিকেট, শিক্ষা পরিষদ ও অর্থ কমিটির মতো স্ট্যাটিউটরি বডিগুলো নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়। বর্তমান ডিনদের মেয়াদ গত ১৭ ডিসেম্বর শেষ হলেও নির্বাচন না হওয়ায় উপাচার্য অধ্যাদেশ অনুযায়ী দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডিনদের কোনো আইনগত ত্রুটি বা অপরাধ নেই বলে মনে করে শিক্ষক ফোরাম।
সংগঠনটির নেতারা বলেন, রাকসু জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারের সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট ও বক্তব্যে ডিনদের অপমান করা হয়েছে এবং শিক্ষক সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। পাশাপাশি কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে হুমকি দেওয়ায় ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলা ও শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী যেকোনো সময় মব সৃষ্টি করছেন, এটা তো হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী চলবে। কেউ নিয়ম অমান্য করছে নাকি তা দেখার জন্য প্রশাসন আছে। একজন শিক্ষার্থীর কাজ তো এসব দেখা না।’
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের দেওয়া বিবৃতির বিষয়ে গতকাল নিজের ফেসবুক আইডিতে সালাহউদ্দিন আম্মার লিখেছেন, ‘আজ শিক্ষকরা আমাকে নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে কেন জানেন? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন এনাদের আশ্রয়স্থল ছিল ওই আওয়ামীপন্থিরাই। দিনশেষে এরা একা।’
রাকসু জিএসের যত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
সালাহউদ্দিন আম্মারের বিরুদ্ধে অনুদানের নামে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘৩৬ জুলাই: মুক্তির উৎসব’ কনসার্ট আয়োজনের জন্য ৭০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৭৬ লাখ টাকা অনুদান চেয়ে চিঠি পাঠান তিনি। ২৯ জুলাই রাজশাহী সিটি করপোরেশনে দেওয়া তাঁর চিঠিটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। সিটি করপোরেশন সে সময় তাঁকে দুই লাখ টাকা অনুদানও দেয়।
২০ সেপ্টেম্বর
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপউপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৮ সেপ্টেম্বর শর্তসাপেক্ষে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে পোষ্য কোটা পুনর্বহাল করা হয়। এর প্রতিবাদে প্রশাসনিক ভবনের সামনে ২০ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে আন্দোলন করছিলেন সালাহউদ্দিন আম্মারের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী। সেদিন বিকেলে অধ্যাপক মাঈন উদ্দিনের গাড়ি আটকে গাড়ির ওপর ‘প্রতীকী ভিক্ষা’ দেন তারা।
বিকেল পৌনে ৪টায় উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ কয়েক শিক্ষক রওনা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাব অর্থাৎ জুবেরী ভবনের উদ্দেশে। এ সময় সালাহউদ্দিনসহ অন্যরা তাদের পিছু নেন এবং তারা পৌঁছানোর আগেই জুবেরী ভবনের ফটকে অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা হাতে হাত দিয়ে বাধা তৈরি করেন। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের মাঝে ধস্তাধস্তি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ঘটনার এক পর্যায়ে ভবনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময়ে এক শিক্ষার্থী উপ-উপাচার্যের হাত টেনে ধরলে তিনি সিঁড়ির ওপর পড়ে যান। সেদিন রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত উপ-উপাচার্যকে জুবেরী ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। রাত ১টার দিকে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন উপাচার্য।
৯ নভেম্বর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ নিজ দপ্তরে সেদিন দুপুরে রাজশাহী মহানগর এনসিপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করছিলেন। সে সময় চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি সমস্যা সমাধানের জন্য রেজিস্ট্রার দপ্তরে যান সালাহউদ্দিন আম্মার। এ সময় রেজিস্ট্রার বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করছেন অভিযোগ তুলে তাঁর কার্যালয়ে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেন তিনি। সেখানে তারা একপর্যায়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
২৬ নভেম্বর
১৫ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘৩৬ জুলাই: মুক্তির উৎসব’ কনসার্টের আয়োজন করেন সালাহউদ্দিন। তাঁর ভাষ্য, এই আয়োজনে আসার জন্য ১৯ জুলাই আর্টসেলের ম্যানেজার খাদেমুল ওয়াহাব মাহের এবং কণ্ঠশিল্পী ও গিটারিস্ট লিংকন ডি কস্তা চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। তবে, অনুষ্ঠান শুরুর ৫ ঘণ্টা আগে তারা ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানান, অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না। তারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করায় ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয় আয়োজকদের। এ কারণে সালাহউদ্দিন আম্মার বাদী হয়ে আর্টসেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
১৮ ডিসেম্বর
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল শেষে সমাবেশে সালাহউদ্দিন আম্মার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘প্রথম আলো-ডেইলি স্টারসহ সব সুশীল গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিতে হবে।’
১৯ ডিসেম্বর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা চাকরি করলে তাদের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেঁধে রাখার হুমকি দিয়েছেন সালাহউদ্দিন আম্মার। ওসমান হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে তিনি এ হুমকি দেন।
২১ ডিসেম্বর
২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর ডিন নির্বাচন হয়। এর মধ্যে ১২টি অনুষদের ডিন নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি হলুদ প্যানেল থেকে ছয়জন প্রার্থী নির্বাচিত হন। গত ১৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ডিনদের মেয়াদ শেষ হয়। তবে উপাচার্য ১১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এসব ডিনকে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নিজ পদে বহাল থাকার নির্দেশ দেন। ১৮ ডিসেম্বর আওয়ামীপন্থি ৬ জন ডিনকে পদত্যাগ করার জন্য কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে হুমকি দেন সালাহউদ্দিন। আওয়ামীপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিজ নিজ দপ্তরে দেখলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেঁধে রাখার হুমকিও দেন। ২১ ডিসেম্বর তিন ডিনের কার্যালয়, উপাচার্য ও দুই উপ-উপাচার্যসহ সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার দপ্তরে তালা দেওয়া হয়। এর ফলে সেদিন সন্ধ্যায় ছয় ডিন পদত্যাগ করেন।
ফেসবুক পোস্টে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সালাহউদ্দিন আম্মার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে তিনি এমন ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের সেকশন ৫৫ (৩) অনুযায়ী নৈতিক স্খলন ও অদক্ষতার কারণে বরখাস্ত হবেন উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমাকে আপনারা বলেন বুকে হাত দিয়ে- ক্যাম্পাসের ১৫% শিক্ষকও কি দক্ষ? বা ক্যাম্পাসের নৈতিকতা নিয়ে বাঁচে কতজন? নারী কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ এবং অধ্যাদেশ লঙ্ঘন এই ৩ ক্রাইটেরিয়াতেই ৯৯% শিক্ষকমণ্ডলী আছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে সালাহউদ্দিন আম্মারের এমন মন্তব্যের পর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মাসুদ রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাকসু নেতার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতার, সততার, নৈতিকতার পরীক্ষা দিতে হবে? এসব বিচার-বিবেচনা কারা করবেন, সে-বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। কী শিক্ষক কী শিক্ষার্থী কারোরই সীমা লংঘন করা উচিত নয়।’
বাংলাদেশ জাসদের উদ্বেগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিনদের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন দপ্তরের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া এবং কয়েক শিক্ষককে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে সম্মানহানির ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ জাসদ। গতকাল দলটির সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান এক বিবৃতিতে নিন্দা জানান। বিবৃতিতে জুলাইবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিষয়ে দ্রুত আইনসম্মত স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত ও নিয়োগসংক্রান্ত সব অনিয়ম তদন্ত করে যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্যাম্পাসে মবোক্রেসি ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।