আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫ ● ৪ ভাদ্র ১৪৩২
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫

কী হতে যাচ্ছে জাপায়

সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, সকাল ০৮:২৯

Advertisement Advertisement

ড. কাজল রশীদ শাহীন

জাতীয় পার্টি-জাপার রাজনীতিতে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমেই। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলটি এ রকম অবস্থায় পড়েনি। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার প্রশ্নে দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটি। বর্তমানে যিনি এই পদে আছেন- রওশন এরশাদ, তিনি অসুস্থ। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, তার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো এবং ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে বাদ দিয়ে জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকার বরাবর একটি আবেদন জানিয়েছেন। সেখানে রওশন এরশাদ ও তার পুত্র সাদ এরশাদ এমপি ছাড়া সব এমপির স্বাক্ষর রয়েছে। বিষয়টা কতটা যৌক্তিক এবং এ মুহূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছিল, সেটা ভালো বলতে পারবেন জাপার সংসদ সদস্য ও বর্তমান বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। আমরা শুধু সৌজন্যতা-শিষ্টাচার ও মানবিক দিকটার কথা উল্লেখ করতে পারি। একজন মানুষ অসুস্থ এবং দশ মাস ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি সম্ভবত এ মুহূর্তে দলের সবচেয়ে বয়স্কজন অর্থাৎ মুরব্বি। যদি কোনো প্রকার আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকে তা হলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ কি কোনোভাবে গ্রহণীয় হতে পারে, নাকি সেটা শোভন দেখায়।

ব্যাপারটা যে মোটেই শোভন নয়, সেটা বেরিয়ে এসেছে সদ্য জাপা থেকে বাদ পড়া সাবেক মহাসচিব এবং সংসদে বিরোধীদলীয় হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গার সংবাদ সম্মেলনে। তিনি জানান, স্পিকারের কাছে যখন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণার আবেদনটা জমা দেন। তখন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পষ্ট করেই বলেছেন, একজন মানুষ অসুস্থ, তার বয়সও হয়েছে- এ মুহূর্তে এটা করতে গেলেন?

ওই সংবাদ সম্মেলনে মশিউর রহমান রাঙ্গা আরও একটা কথা পরিষ্কার করে বলেছেন, দেশে দুটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে। জাতীয় পার্টি এই দুটির মধ্যে নেই। বর্তমানের রাজনৈতিক বাস্তবতা তার এই মতামতকে মান্যতা দেয়। কিন্তু তিনি কেন এ কথা বলতে গেলেন ওই সংবাদ সম্মেলনে। এর মধ্য দিয়ে জাপার বর্তমান নেতৃত্ব কি এই বার্তা দিলেন জাপা বিলুপ্তি হবে এবং জাপার নেতাকর্মীরা ওই দুই দলে নিজেদের নাম লেখাবে। লক্ষণীয়, জাপা থেকে বাদ পড়ার পর তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সাংঘাতিকভাবে। তার প্রকাশও ঘটেছিল তার মন্তব্যে- যা গণমাধ্যমে প্রকাশের মধ্য দিয়ে সবার জানা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, জিএম কাদেরকে রংপুরে যেতে দেবেন না। এমনকি লালমনিরহাটে গেলেও তাকে হেলিকপ্টারে যেতে হবে। অর্থাৎ স্থলপথে রংপুরের ওপর দিয়ে তার সব ধরনের যাতায়াত প্রতিহত করা হবে। এই উষ্মা অবশ্য সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত থাকেনি। উল্টো সংবাদ সম্মেলনে তিনি কথা বলেছেন নানা বিষয়ে। ফলে তার মূল বার্তাটা কী সেটা বোঝা যায়নি। তিনি এটাও বলেছেন, চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরকে স্বীকার করেন। অবশ্য রাঙ্গার এই সংবাদ সম্মেলনকে এবং তার আগে-পরের বক্তব্যকে জিএম কাদেরসহ অন্যরা যে খুব বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন তেমনটা মনে হয় না। তাদের অবস্থানেও কোনো হেরফের হয়নি।

এরশাদের মৃত্যুর পর জাপায় বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এই অবস্থা থেকে যদি সুষ্ঠু উত্তরণ না ঘটে তা হলে জাপার ভাগ্যে যে শোচনীয় অবস্থা অপেক্ষা করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনো হতে পারে, উ™ূ¢ত অবস্থা ঠুকে দিতে পারে জাপার ভাগ্যে শেষ পেরেক হিসেবে।

জাপা ভাঙন নতুন কোনো কিছু নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার ভেঙেছে এই দলটি। এখন পর্যন্ত আটবার। দলের এই ভাঙন নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দুঃখ করে বলেছিলেন, যাকে বিশ^াস করে যখনই কোনো বড় পদে বসিয়েছি, দলের মহাসচিব বানিয়েছি, দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী হিসেবে সরকারে পাঠিয়েছি। তিনিই দলে ভাঙন ধরিয়েছেন- দলের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। এরশাদের এই দুঃখ সত্য ছিল। তার পরও দলের নাটাই যতদিন এরশাদের হাতে ছিল ততদিন দলকে তিনি ধরে রেখেছিলেন। এবং ক্ষমতার অংশ হয়ে কাছাকাছি থেকে নিজেদের অস্তিত্বকে নিরাপদ করেছিলেন। প্রশ্ন হলো, এরশাদের অবর্তমানে জাপা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে আদৌ পারবে কি?

এরশাদ এ দেশের রাজনীতিতে নানাভাবেই সৌভাগ্যের অধিকারী। বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো সামরিক স্বৈরাচারের উদাহরণ দেওয়া যাবে না, যিনি ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়ে আমৃত্যু ক্ষমতার সুবিধাভোগী ছিলেন। এটা যে কত বড় ব্যর্থতা ও লজ্জার সেই হিসাব এখন হয়তো করা হচ্ছে না। কিন্তু একদিন ঠিকই করতে হবে। ইতিহাসের ধর্ম হলো, ইতিহাস কাউকে ছাড় দেয় না। হয়তো সময়ক্ষেপণ করে। কিন্তু ভুলে যায় না কোনো কিছুই। নব্বই-পরবর্তী সময়ে আমরা দেশের দুই প্রধান দলকেই দেখেছি নিজেদের স্বার্থে এবং প্রয়োজনে স্বৈরাচারকে কাছে টানতে কোনো প্রকার দ্বিধান্বিত না হতে। এমনকি সদ্য বাদ পড়া জাপা নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন যা শুধু নূর হোসেনের জন্য নয়- গণতন্ত্রকামী শুভবোধসম্পন্ন সব মানুষের জন্য বেদনা ও লজ্জার। অথচ সেই সময় জোরালো কোনো প্রতিবাদ হয়নি রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ যে কী এবং ক্ষমতার স্বাদ ও উচ্ছিষ্ট যে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শকে কীভাবে গিলে খায় তার বাস্তবতা দৃশ্যমান হচ্ছে নব্বই-পরবর্তী দীর্ঘ তিন দশকে। আর এসবের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধা লুটেছে জাপা। এবং এই সুবিধার বাটখারায় যখনই টানাপড়েন ঘটে তখনই দলটিতে দেখা দেয় নানান ধরনের সংকট। যার প্রথমটা দৃশ্যমান হয় পদ-পদবি থেকে বাদ পড়া কিংবা ছিটকে পড়ার মধ্য দিয়ে। আর শেষটা দৃশ্যমান হয় দল ভাঙনের মধ্য দিয়ে। এ কারণে জাপার মহাসচিব পরিবর্তন, দল ভাঙন যেন তাসের ঘরের মতো কেবলই খানখান হয়ে পড়ে।

জাপা এবার যে পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়েছে তার ওপরই নির্ভর করছে জিএম কাদেরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে জাপার বাঁচা-মরা। জাপা চেয়ারম্যানের গত ছয় মাসের বক্তৃতা-বিবৃতির দিকে আমরা যদি খেয়াল করি তা হলে আমরা দেখব, তিনি যেন হঠাৎ করেই অন্যরকম একজন রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। জাতির বিবেকের জায়গায় দাঁড়িয়ে ন্যায্য কথা বলার চেষ্টা করছেন। বিষয়টা কৌতূহলোদ্দীপক। জাপার রাজনীতির সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ নয়। অথচ তিনি একের পর এক ন্যায়সঙ্গত কথা বলে সংবাদমাধ্যম তো বটেই, রাজনীতিসচেতন সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। জাপা চেয়ারম্যানের এই রাজনীতিকে কোনোভাবেই সাদা চোখে দেখার উপায় নেই। বরং জিএম কাদেরের এই রাজনীতি, বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশবিশেষ কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মনে। যার উত্তর অন্বেষণ করার আগেই বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার প্রশ্নে জাপা এসে দাঁড়িয়েছে গভীরতর এক সংকটে।

জিএম কাদের কি বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার লক্ষ্যেই এতদিন মাঠ গরম করার চেষ্টায় ছিলেন। এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কৌশল হিসেবে এসব করলেন। এসব প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর আমাদের জানা না থাকলেও এসব সম্ভাবনাকে কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। জাপা চেয়ারম্যানের এই কৌশল কতটা কাজে লাগে সেটাই এখন দেখার বিষয়। অবশ্য ইতোমধ্যে যতটুকু দৃশ্যমান হয়েছে তাতে সহসা এই সংকটের সমাধান হবে না, যতদিন রওশন এরশাদ জীবিত আছেন ততদিন বিরোধীদলীয় নেতা তিনিই থাকবেন। ফলে কৌশলে জাপা চেয়ারম্যান নিজের ফাঁদে নিজেই আটকা পড়লেন তা স্পষ্টত।

জাপা চেয়ারম্যানের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কীভাবে নেয় সেটাও দেখার বিষয়। কয়েকদিন আগে জিএম কাদের বলেছেন, জাপা কোনো জোটে নেই। নির্বাচন সামনে এলে জাপা নেতৃত্বের এ রকম বক্তব্য নতুন নয়, বরং বরাবরের অভ্যাস। এরশাদ সাহেব হেঁটেছেন সেই পথেই। অনুজ জিএম কাদেরও কি সেই পথের পথিক হলেন?

কে না জানে, জাপা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে রয়েছেন এবং এখনো আছেন। এখন সুবিধা নেবেন আবার বড় বড় কথাও বলবেন, এই সহনশীলতা আওয়ামী লীগ কতদিন দেখায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভালোতে আছি কালোতে নয়, সেটা তো দোসর রাজনীতির জন্য গ্রহণীয় হতে পারে না।

জাপা চেয়ারম্যানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি আদৌ কী চান, কেমনভাবে চান, কতটা চান? তিনি যদি মনে করেন রাজনৈতিক মিত্রতার প্রশ্নে তাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাত্রা স্বস্তির হচ্ছে না। তা হলে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্মেও আছেন আবার জিরাফে আছেন। এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

জাপার সুযোগ ছিল তৃতীয় একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করার। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হিসেবেও তারা রংপুর অঞ্চলে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করতে পারত এবং সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা সারাদেশে নিজেদের নতুন মাত্রায় হাজির করতে পারত। কিন্তু সেসবের কোনো কিছুকেই কাজে লাগায়নি দলটি। জাপা চেয়ারম্যান কি দলের ভবিষ্যতের প্রশ্নে বৃহত্তর কোনো রোডম্যাপ নিয়ে ভাবছেন, নাকি রাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণীকেই দলের ভবিতব্য জ্ঞান করছেন যে, দেশে আগামীতে দুটি রাজনৈতিক দল থাকবে।

ধর্মে ও জিরাফের থাকা নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে জাপাকে। অতীতে যেটা এরশাদ করেছেন, বর্তমানে যেটা জিএম কাদের করছেন। সরকারের সুবিধাবাদের ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে সরকারবিরোধী কথা শুনতে ভালো লাগলেও কারও কাছে কোনো প্রকার আবেদন তৈরি করে না।

ভারতের জয়পুরের মহারাজ তার চিড়িয়াখানার জন্য একটা জিরাফ এনেছিলেন। যা দেখার জন্য আশপাশের এলাকা থেকে মানুষের প্রতিদিনের সমাগম বেড়ে যায়। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে মহারাজের বিরোধী পক্ষ রটিয়ে দেয় যে, জিরাফ দেখা ধর্মে বারণ আছে, এটা দর্শনে পাপ হয়। এদিকে মহারাজ জিরাফ দর্শনের জন্য দিনের পাশাপাশি রাতেও ব্যবস্থা করলেন। তখন দেখা গেল যারা দিনের বেলায় জিরাফ দেখা পাপ বলে চিৎকার করছে তারা রাতের বেলায় জনচক্ষুর আড়ালে জিরাফ দেখতে যাচ্ছে। সেই থেকে এই কথার উদ্ভব, ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে। জাপাকে তার অস্তিত্বের প্রশ্নে এবং বাস্তবিকই যদি গণমানুষের রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সদিচ্ছা থাকে তা হলে ধর্ম ও জিরাফে থাকার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে স্পষ্ট করতে হবে নিজেদের অবস্থান।

ড. কাজল রশীদ শাহীন : সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

মন্তব্য করুন


Link copied