আর্কাইভ  সোমবার ● ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ● ১৪ আশ্বিন ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৪ ঘণ্টা পর ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক

৪ ঘণ্টা পর ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক

অরণ্যে আওয়ামী লীগ, রাস্তায় গর্ভপাতের উন্নয়ন

অরণ্যে আওয়ামী লীগ, রাস্তায় গর্ভপাতের উন্নয়ন

ফেসবুকে ‘বাংলাদেশের জার্সি আর গায়ে দেওয়া হলো না’ লিখলেন সাকিব

ফেসবুকে ‘বাংলাদেশের জার্সি আর গায়ে দেওয়া হলো না’ লিখলেন সাকিব

এশিয়া কাপ: পাকিস্তানকে হারিয়ে আবারও চ্যাম্পিয়ন ভারত

এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ভারতেরই
এশিয়া কাপ: পাকিস্তানকে হারিয়ে আবারও চ্যাম্পিয়ন ভারত

দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন

হাবিবের ‘মহা জাদু’ ও একজন বাউল খোয়াজ মিয়া

রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাত ১১:২৩

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: হঠাৎ করে একটি গান নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে। ‘মহা জাদু’ শিরোনামের এই গানটি কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় সিজনের ষষ্ঠ গান। গানটিতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ ও তাজিকিস্তানের শিল্পী মেহেরনিগর রুস্তম কণ্ঠ দিয়েছেন। গানে দারুণ মেলবন্ধন ঘটেছে বাংলা ও ফারসি ভাষার।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগীতপ্রেমীদের মাঝে চলছে ব্যাপক আলোচনা। মহা জাদু গানটির মূল গীতিকার বাংলাদেশের বাউল খোয়াজ মিয়া। গানের ফারসি অংশের গীতিকার হাদিস দেহঘান।

বাংলার সঙ্গে ফারসির মেলবন্ধন

ভাষাবিদ ড. শহীদুল্লাহর মতে, সম্রাট আকবরের সময় বাংলা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আর সে সময় রাজভাষা ছিল ফারসি, যা দীর্ঘ ছয়শ বছর একই অবস্থানে থেকে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এটি ভৌগোলিকভাবে বাংলা ভুখন্ডের জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব ফেলেছে। 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফারসি ভাষার অনেক ব্যবহার আছে। যেমন- ভালোবাসার প্রতীক গোলাপ; আদালত, কাগজ, বরফ, খোদা ইত্যাদি শব্দ ফারসি ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে। এরকম আরও বহু শব্দ আছে। ভাষার এ মেলবন্ধনকে কাজে লাগিয়ে সংগীতপ্রেমীদের মনে আলাদা দোলা দিয়েছে কোক স্টুডিও। তারা বানিয়েছে বাংলা-ফারসি ভাষার গান ‘আমার বন্ধু মহা জাদু জানে’।

বাউল খোয়াজ মিয়া । ছবি : ফেসবুক থেকে 

সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটির প্রভাব

‘মহা জাদু’ গানে সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটির প্রভাব আছে। সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটি হলো সংস্কৃতির মিশ্রণ বা সমন্বয়ের এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে দুটি বা একাধিক সংস্কৃতি পরস্পরের প্রভাব গ্রহণ করে এবং নতুন সাংস্কৃতিক অর্থ, রীতি, প্রতীক ও চর্চার সৃষ্টি করে। উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক হোমি কে. ভাভা ‘সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটি’ ধারণা দেন।

‘মহা জাদুর’ গীতিকার বাংলাদেশের বাউল খোয়াজ মিয়া, আবার ফারসি অংশের গীতিকার হাদিস দেহঘান। এ দুজনকে নিয়ে কোক স্টুডিও বাংলা আধুনিক সংগীতায়োজন করেছে। এটি ওই সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটির প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ দুটি ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। ঐতিহ্যবাহী লোকগীতির সাথে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের এই মেলবন্ধন বাউল খোয়াজ মিয়ার দর্শনকেও নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এটি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে একটি সহাবস্থান তৈরি করেছে, যা খোয়াজ মিয়ার গানকে অমর করে তুলেছে।

কে এই বাউল খোয়াজ মিয়া?

বাউল খোয়াজ মিয়া ১৯৪২ সালের ১২ই মার্চ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা মরমী সাহিত্যের এক নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ কবি ও সাধক। খোয়াজ মিয়া বাউল গান ও সুফিবাদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত আধ্যাত্মিক গান রচনা করেছেন। 

তার জন্মস্থান সম্পর্কে তিনি নিজেই তার গানের মাধ্যমে পরিচয় তুলে ধরেছেন, যা তার ভৌগোলিক শেকড়ের প্রতি গভীর মমত্ববোধের পরিচায়ক। তিনি গেয়েছেন, ‘দৌলতপুর ইউ পি, পোস্ট অফিস ঠিকানাতে লেখি, ঐ গেরামে জন্ম আমার, ঐ গেরামে থাকি।’

শৈশব থেকেই খোয়াজ মিয়া সংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। পড়াশোনার চেয়ে বাঁশি বাজানো এবং গান গাওয়ার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল তীব্র। তার এই অনুরাগ তার পারিবারিক পরিবেশের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে। কারণ তার পিতা একজন মৌলভী হওয়ায় বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র বা গান-বাজনা নিষিদ্ধ ছিল। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, তিনি গোপনে বিভিন্ন গ্রামে গানের আসরে ছুটে যেতেন। 

বাউল খোয়াজ মিয়া । ছবি : ফেসবুক থেকে 

খোয়াজ মিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতেই শেষ হয়। এটি তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, যা কোনো ব্যর্থতা নয় বরং তার নিজস্ব দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির এক সুস্পষ্ট প্রতিফলন। তার নিজের রচিত গানে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন, যে বিদ্যা ঘুষখোর, মদ্যপ এবং স্বার্থপর সমাজ প্রতারক তৈরি করে : ‘যে বিদ্যা হয় ঘুষখোর মদখোর, স্বার্থপর সমাজ ঠকায়।’

খোয়াজ মিয়া শরিয়তকে মূল্যায়ন করে অনেক ইসলামী ভাববাদী গান লিখেছেন। বিভিন্ন ধর্মের শাস্ত্রীয় গানও লিখেছেন তিনি। তাঁর কিছু গানে উঠে এসেছে সমসাময়িক পরিস্থিতির কথা। আধ্যাত্মিক কথাকে তিনি সহজভাবে গানে উপস্থাপন করেছেন।

শিষ্যত্ব এবং সত্যের অনুসন্ধান : আধ্যাত্মিক গুরুদের প্রভাব

১৯৬২ সালে ২২ বছর বয়সে খোয়াজ মিয়া তার পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে আধ্যাত্মিক গুরুর সন্ধানে বাড়ি ছাড়েন। এই সিদ্ধান্ত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং তাঁর আনুষ্ঠানিক সাধনার সূচনা করে। এই সময়েই তার গানের বিষয়বস্তু বিনোদন থেকে আধ্যাত্মিক ও মানবতাবাদী দর্শনের দিকে মোড় নেয় ।   

তিনি ‘জ্ঞানের সাগর’ নামে খ্যাত প্রখ্যাত মরমি সাধক ফকির দুরবিন শাহর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু দুরবিন শাহর সান্নিধ্যে আসার পর তিনি একনিষ্ঠভাবে তার সাধনায় মগ্ন হন এবং গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক দর্শন ও মানবতাবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। গুরুর আদেশ ও নিয়মকানুন শ্রদ্ধার সাথে পালন করে তিনি পরমাত্মার অন্বেষণ এবং আত্মমুক্তির কৌশল আয়ত্ত করেন ।   

খোয়াজ মিয়া একই দিনে ফকির দুরবিন শাহর শিষ্যত্ব গ্রহণের পাশাপাশি সাধক ফকির 'ছাবাল শাহ'-এর কাছেও 'বায়াত' (আধ্যাত্মিক আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন। তার গানে তিনি কামিল মুর্শিদের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন (“কামিল মুর্শিদ সাত রাজার ধন ভজলে মিলে পরশ রতন করলে সাধন হয় মহাজন চৌদ্দ পুরুষ স্বর্গে যায়”)। 

দেহতত্ত্বের দর্শন 

খোয়াজ মিয়ার গানের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো 'দেহতত্ত্ব'। এই দর্শন অনুসারে মানবদেহ হলো মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ এবং এখানেই আধ্যাত্মিক মুক্তি ও সৃষ্টিকর্তার সাথে মিলনের পথ নিহিত। তার গানে তিনি আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য দেহের ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যেমন তার একটি গানে তিনি লিখেছেন, ‘প্রেমাগুনে দেহ আত্মা, করো ভাজা ভাজা/দুই নয়নের জল দিয়া, বুকের বসন ভিজা।’

খোয়াজ মিয়ার গানের দর্শন কেবল দেহতত্ত্বেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার গান বাউল ও সুফিবাদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হলেও তা মানবতাবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক বার্তা বহন করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ‘খোদাকে চিনিতে হলে, আগে চেনো আপনারে’ যা সুফিবাদের একটি মৌলিক ধারণা।

আধুনিক সংগীতে মরণোত্তর জনপ্রিয়তা

চলতি বছরের ২৬ জুন মারা গেছেন বাউল খোয়াজ মিয়া। ‘মহা জাদু’ গানটি তাকে আধুনিক সংগীতে মরণোত্তর জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। লেখক ও গবেষক গৌতম কে শুভর নেওয়া সাক্ষাৎকারে খোয়াজ মিয়া জানিয়েছিলেন, ‘গানটা লেখা হয়েছে ১৯৬৮ সালের দিকে। তখন আমি আত্ম-অনুসন্ধান করছিলাম।’

সৈয়দা আঁখি হক ও বাউল খোয়াজ মিয়া । ছবি : ফেসবুক থেকে 

খোয়াজ মিয়ার জীবন, গান ও দর্শন নিয়ে বই লিখেছেন সৈয়দা আঁখি হক যেটি ‘সময় প্রকাশন’ থেকে প্রকাশ হয়েছে ২০১৯ সালে। আঁখির কথায়, ‘খোয়াজ মিয়া মূলত আধ্যাত্মবাদের ওপর ভর করে গান লেখেন। এই গানটিও তা-ই। তার মুর্শিদের প্রেমে তিনি পাগল গানে উপমা হিসেবে তিনি অনেক অনুসঙ্গ এনেছেন। সেগুলো দেখে মনে হতে পারে, এটা প্রেমের গান। এখানে প্রেমিকার প্রতি নিবেদন বা প্রেমিকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মুর্শিদের মধ্য দিয়ে তিনি তার স্রষ্টাকে চেয়েছেন। গানে সেই কথাই এসেছে উপমা হিসেবে।’

মন্তব্য করুন


Link copied