শেখ মাজেদুল হক
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় সমগ্র পৃথিবী বদলে যাচ্ছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মূলত প্রযুক্তির বিপ্লব, যা পৃথিবীর মানুষকে এক লাফেই ১০০ বছর সামনে নিয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, এই পরিবর্তন সব মানুষের জীবনমান উন্নত করবে, আয় বাড়াবে সব শ্রেণির মানুষের। প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প অর্থনীতির সকল ক্ষেত্র। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বগ্রামে পরিণত করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে অভাবনীয় উন্নত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হবে পাড়ার দোকানে কেনাবেচার মতই সহজ। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং স্বয়ংক্রিয়-করণ (অটোমেশন) এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বেশিরভাগ সমস্যা নিরূপণ, সমস্যা বিশ্লেষণ, সমাধান প্রদান, মেশিন টু মেশিন যোগাযোগ, ইন্টারনেট অব থিংস, সম্মিলিতভাবে এসবগুলোকেই একত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে বুঝানো হচ্ছে। অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে যন্ত্র ও প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে দ্রুততর করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমকে আরও বেশি গতিশীল ও নিখুঁত করে তুলছে।
‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রোভাইডার এয়ারবিএনবির নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।’
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি শত সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচন করছে। এ সময় দক্ষ নেতৃত্ব ও গুণগত শিক্ষার ওপর জোর দেয়া আবশ্যক। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের। শিক্ষার বহুমাত্রিকতা আগামীর নেতৃত্ব গঠনে ভূমিকা রাখবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বানানো স্যাটেলাইট ‘ব্র্যাক অন্বেষা’ এখন মহাকাশে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের শিক্ষার্থীরা টেক্কা দিচ্ছে নামীদামী আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণা, সরকার ও শিল্প খাতের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা জরুরি। আমাদের যে করেই হোক গবেষণায় আরও অর্থ বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের তরুণদের চিন্তা করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পড়াশোনায় বৈচিত্র্য বাড়ানো দরকার। আমাদের যেমন গণিত নিয়ে পড়তে হবে, তেমনি পড়তে হবে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে। প্রোগ্রামিংসহ বিভিন্ন প্রাথমিক দক্ষতা সবার মধ্যে থাকা এখন ভীষণ জরুরি। শিক্ষার্থীদের প্রচলিত প্রশ্নোত্তর থেকে বের করে এনে তাদের কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মূল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকাশযোগ্যতা, দলীয় কাজে দক্ষতা তৈরির জন্য ওই সব কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা প্রজেক্টের উপস্থাপনাকে করতে হবে বাধ্যতামূলক এবং সেটি শুধু নিজ নিজ শ্রেণীকক্ষে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, ছড়িয়ে দিতে হবে নানা অঙ্গনে।
উচ্চশিক্ষার সব স্তরে শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষানবিস কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্ক হাতেকলমে শিখতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করে এটিকে আশঙ্কার পরিবর্তে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হলে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। তবে, সেটি গুটিকয় লোকের একটি সভার মাধ্যমে না করে একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে করা প্রয়োজন। নতুবা ২০৩০ সালে আমরা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করব, সমাজে যাদের কোনো চাহিদাই থাকবে না।
আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, হাইটেক পার্কসহ সবাই এক হয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিষয়টি মনে-প্রাণে ধারণ করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং এ খাতে পর্যায়ক্রমে বাজেট বাড়াতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ও ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো, বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্ম-নিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ভোটার আইডি কার্ড, ই-টিন সার্টিফিকেট ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে আরও কর্মক্ষম বাংলাদেশ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা-পূর্ণ বাংলাদেশ, ন্যায়সঙ্গত বাংলাদেশ এবং আরও অধিক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ৫২ হাজারের বেশি ওয়েবসাইটে ভরপুর জাতীয় তথ্য বাতায়নে যুক্ত রয়েছে ৯৫ লাখেরও অধিক বিষয়ভিত্তিক কনট্যান্ট এবং ৬৮৫টির বেশি ই-সেবা, যা খুব সহজেই মানুষ অনলাইনে পাচ্ছেন। জাতীয় হেল্প-লাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৭ কোটির বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল সেন্টার, জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও মাইগভ. থেকে প্রতি মাসে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখের বেশি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাদরাসাসহ মাধ্যমিক স্তরে) ও ১০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন করা হয়েছে।
২০০৯-১৯ অর্থবছরে ১২৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব এবং ১০০টি ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। সবগুলো ইন্টারনেট সেবা ২০২৩ সালে তৃতীয় সাবমেরিন কেবলে সংযোগ হবে। ২০২৫ সাল নাগাদ শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করা হয়েছে; যেটি ব্যবসার মডেল, শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান, প্রচলিত ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো, বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্ম-নিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ভোটার আইডি কার্ড, ই-টিন সার্টিফিকেট ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রতি উপজেলায় একটি করে কারিগরি কলেজ স্থাপনের কাজ পুরোদমে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সারা দেশের সব বিভাগ-জেলায় হাই-টেক ও আইটি পার্ক স্থাপনেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ পর্যন্ত নির্মিত ৩৯টি হাই-টেক পার্কের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ দক্ষ জনবল তৈরি করে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, ৯টি হাই-টেক পার্কে দেশি-বিদেশি ১৬৬টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে, যাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আইসিটি রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে বর্তমানে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিদ্যমান প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে আয় হচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কর্মসংস্থান ও মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে যথাক্রমে ২১ হাজার ও ৩২ হাজার। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই রাঙ্গামাটি পাবর্ত্য জেলার কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়াতে একটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র চালু করেছিলেন। বাংলাদেশ এখন দুটি সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে, তৃতীয় সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে কানেকটিভিটির কাজ চলছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সরকার আকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার মাধ্যমে আগামী দিনের বিশ্বকে জানান দিচ্ছে— চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশও প্রস্তুত।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
Email: smh.mkt@brur.ac.bd