বিশেষ প্রতিনিধি॥ বাড়ির সামনের চলাচলকৃত রাস্তা প্রতিবন্ধকতা সৃস্টি করে মার্বেল দিয়ে জুয়া খেলছিল বেশ কিছু বখাতে যুবক। যার প্রতিবাদ করেছিলেন মিলন ইসলাম (৩৮) নামে এক ভ্যান চালক। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বখাটেরা ভ্যানচালক মিলকে পিটিয়ে হত্যা করে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী। নিরিহ একটি সুখী পরিবার হঠাৎ করেই কার্যত শেষ হয়ে গেছে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ বাবা তোফাজ্জল হোসেন ও বৃদ্ধা মা লিলি বেগম। অপর দিকে স্বামীকে চিরতরে হারিয়ে স্ত্রী মুক্তা বানু বেগম(৩৫) দিশেহারা। আর বাবাকে হারিয়ে তিন সন্তান মোরসালিন(১২) মোজাহিদ(১০) ও নুসরাত জাহান মাহি(৩) নির্বাক।
সরেজমিনে গিয়ে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গী মাঝাপাড়া গ্রামের গ্রামবাসী সহ হত্যার শিকার ভ্যান চালকের স্বজনরা জানায়, হত্যাকান্ডের পর বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী জড়িত ৭ জনের মধ্যে দুইজনকে আটক করে পুলিশকে দিলেও পুলিশ অপর পলাতক ৫ জন আসামীকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, আসামীরা প্রভাবশালীদের ছত্র ছায়ায় থেকে উল্টো হুমকী ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামীকে পুলিশ রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে স্বীকারোক্তি জবাববন্দীর ব্যবস্থাও করেনি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
সুত্র মতে, এই ঘটনায় নিহত মিলনের স্ত্রী মুক্তাবানু বাদী হয়ে গ্রামের আনিছুর রহমান(৪৮) ও তার দুই ছেলে খোকন ইসলাম(২০) ও রিপন ইসলাম (২৫), সিরাজুল ইসলাম(৫২) ও তার দুই ছেলে বিপুল ইসলাম (২৭) ও স্বপন ইসলাম (২৪) এবং আব্দুল কাদেরের ছেলে মানিক ইসলামের (৪০) নামে জলঢাকা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। এদের মধ্যে ঘটনার দিন গ্রামবাসী বিপুল ইসলাম ও স্বপন ইসলামকে ধাওয়া করে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়।
গ্রামবাসীরা জানায়, ঘটনার একদিন পর এলাকার নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) স্বতন্ত্র এমপি সাদ্দাম হোসেন পাভেল নিহত ভ্যানচালকের বাড়ীতে এসেছিলেন। তিনি নিহতের পরিবারকে ঘটনার সমাধান করে দিতে চেয়েছেন। কিন্ত কি সমাধান করে দিবেন আমরা তার কথা বুঝিনা নাই। আমরা যা বুঝি তা হলো ভ্যান চালক মিলন হত্যায় ন্যায় বিচার চাই। আসামীদের ফাঁসি চাই।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ গ্রামবাসী জানান, বখাটে যুবকরা এলাকার অন্য যুবকদের জুয়ার আশক্ত করার চেষ্টা করছিল। তারা মাদকাশক্তও। এনিয়ে আমরা অনেকে প্রতিবাদও করেছি। কিন্তু ক্ষমতাশালী দলের বিশেষ করে ছাত্রলীগের সাথে এরা জড়িত থাকায় এদের বিরুদ্ধে কখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, সঠিকসময়ে যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতো, তাহলে আজ বৃদ্ধ বাবা মাকে তার ছেলে ও স্ত্রীকে স্বামী ও সন্তাদের বাবা হারাতে হতো না। সংসদ সদস্য সমাধানের কথা বলছেন। তাহলে কি একটি হত্যার বিচার কি সমাধানে হয়ে যায়।
সুত্র মতে, এই ঘটনায় নিহত মিলনের স্ত্রী মোছা মুক্তা বানু বাদী হয়ে গ্রামের আনিছুর রহমান (৪৮) ও তার দুই ছেলে খোকন ইসলাম (২০) ও রিপন ইসলাম (২৫), সিরাজুল ইসলাম (৫২) ও তার দুই ছেলে বিপুল ইসলাম (২৭) ও স্বপন ইসলাম (২৪) এবং আব্দুল কাদেরের ছেলে মো. মানিক ইসলামের (৪০) নামে জলঢাকা থানায় হত্যা মামলা করেন।
দায়ের করা মামলা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সুত্র মতে, “গত ৩০ জানুয়ারী বিকেল ৩ টায় আসামীরা সহ বেশ কিছু যুবক ভ্যানচালক মিলনের বাড়ীর সামনের রাস্তায় চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃস্টি করে মার্বেল দিয়ে জুয়া খেলছিল। ওই সময় নিহত মিলন ভ্যান চালিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ীতে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মার্বেলের জুয়া খেলা নিয়ে ওই সকল যুবকদের মধ্যে হট্টগোল বাধে। ভ্যান চালক মিলন বাড়ি থেকে বাহিরে এসে তার বাড়ীর সামনে মার্বেল খেলতে নিষেধ ও হট্টগোল না করার জন্য অনুরোধ করেন। এসময় আসামীদের মধ্যে স্বপন ক্ষিপ্ত হয়ে ভ্যান চালক মিলনের হাতের আঙ্গুল কামড় দেয়। মিলন তার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য স্বপনকে ধাক্কা দিলে পিছন থেকে খোকন ইসলাম জলপাই গাছের মোটা ঠাল দিয়ে মিলনের মাথায় সজোরে আঘাত করে। এতে তৎক্ষনাত মিলন মাটিতে পড়ে গেলে মাথা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ওই অবস্থায় মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছিল ভ্যান চালক। এসময় অপর আসামীরা এসে মাটিতে পড়ে থাকা ভ্যান চালক মিলনকে এলোপাথারি লাথি মারতে থাকে। স্বামীকে রক্ষা করতে তার স্ত্রী মুক্তা বানু, মা লিলি বেগম ও স্থানীয় প্রতিবেশী ওমর ফারুক এগিয়ে আসলে অভিযুক্তরা তাদেরকেও মারতে শুরু করে। পরে স্থানীয়রা ছুটে এসে তাদের হাত থেকে আহত মিলন ও তার পরিবারকে ছাড়িয়ে নেয়। গুরুতর রক্তাত্ব আহত অবস্থায় মিলনকে জলঢাকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ভ্যান চালক মিলনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থনান্তর করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন রাত ১১টায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে মিলন।”
পরের দিন ৩১ জানুয়ারী ভ্যান চালক মিলনের লাশের ময়নাতদন্ত হয় রংপুর মেডিকেলে। সেখান থেকে মরদেহ এনে সন্ধ্যায় গ্রামে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। ওইদিন রাতেই মিলনের স্ত্রী বাদী হয়ে জলঢাকা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী ওমর ফারুক (১৯) বলেন, স্বাভাবিকভাবেই মিলন ভাই বাড়ীর সামনে জুয়া খেলতে বারণ করলো তাদের। তার বাড়ীতে ছোট ছেলে-মেয়ে আছে তারা এগুলো জুয়া খেলা শিখতে পারে তাই এখানে খেলতে নিষেধ করলো। কিন্তু এক পর্যায় তারা মিলন ভাইয়ের উপর চড়াও হয় এবং স্বপন এসে তার আঙ্গুল কামড়ে ধরে। আঙ্গুল ছাড়াতে স্বপনকে ধাক্কা দিলে পিছন থেকে খোকন মোটা ঠাল দিয়ে মাথায় মারে। এসময় আমি মিলন ভাইকে বাঁচাতে গেলে তারা আমাকেও মারতে থাকে। অপর প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী গোলাম জাকারিয়া বাবু (৪৬) বলেন, আমি জমিতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেচামেচি শুনে আমি ছুটে আসতেই দেখি খোকন একটি মোটা ঠাল দিয়ে মিলনের মাথায় আঘাত করলো। আঘাত করা মাত্রই মিলন মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায় ও তার মাথা থেকে রক্ত ঝড়তে থাকে। মাটিতে থাকা অবস্থাতেও তারা (অভিযুক্তরা) মিলনকে মারতেই থাকে। তার মা-স্ত্রী এগিয়ে আসলে তাদেরকেও মারতে থাকে। এলাকার ওই হত্যাকারীরা সন্ত্রাসী ও জুয়ারী। তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। কিছুদিন আগেও এলাকার জুখেখা বেগম নামে এক গৃহবধুর হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল। এছাড়া রাতে ছিনতাই ও মাদক সেবন করে তারা। অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বেলাল হোসেন বলেন, মিলনের মাথা দিয়ে রক্ত বের হতে থাকলেও তারা (অভিযুক্তরা) মাটিতে পড়া অবস্থায় তাকে মারতেই থাকে। মা, স্ত্রী এগিয়ে আসলে তাদেরকেও মারতে থাকে। গুরুতর আহত অবস্থায় মিলনকে আমরা তাদের হাত রক্ষা করে ভ্যানে যখন উঠাই তখনও তারা ভ্যানে শোয়ানো অবস্থায় মারতে থাকে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মিলন ইসলাম। তার মৃত্যুতে দিশেহারা সকলে। হয়ে ছেলেকে হারিয়ে মা বাবা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাদের মানুষ করবেন তা ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছে না নিহত মিলনের স্ত্রী মুক্তাবানু। অর্থাভাবে ন্যায় বিচার পাবে কি না সে নিয়েও রয়েছে তাদের শঙ্কা।
নিহত মিলনের মা লিলি বেগম বিলাপ করে বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে, আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব? আমার পুত্রবধু অসহায় হয়ে পড়েছে। নাতি-নাতনিরা কাকে বাবা বলে ডাকবে? ওদের এখন কে দেখবে? সামান্য মার্বেল খেলতে নিষেধ করায় ওরা আমার ছেলে মিলনকে এভাবে খুন করতে পারলো? আল্লাহ ওদের মাফ করবে না। আমি ওদের ফাঁসি চাই।
শোকে তিন সন্তান নিয়ে দিশেহারা নিহত মিলনের স্ত্রী মুক্তা বানু। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আসামীরা আমাদের দেড়শতক জমি দখলের চেস্টা করেছিল। এমনকি তাদের কাছে জমি বিক্রি করার জন্য আমার স্বামীকে চাপ দিয়ে আসছিল। এতে রাজি ছিল না স্বামী। স্ত্রীর ধারনা মার্বেল খেলতে নিষেধ করার ঘটনাটি পুঁজি করে ওই জমি দখলের ব্যর্থ হবার ক্ষোভে আসামীরা সবাই মিলে পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে খুন করেছে। ছেলে-মেয়েদের কিভাবে মানুষ করবো? কিভাবে সংসার চলবে? আর কিভাবেই বা স্বামী হত্যার বিচার পাবো? তারা টাকাওয়ালা শক্তিশালী মানুষ। গ্রামবাসী দুই আসামীকে ধরে পুলিশকে দেয়। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পলাতক ৫ আসামী রয়েছে। পুলিশ তাদের ধরেনা। উল্টো আমাদের হুমকী দিচ্ছে। তিনি জানান, এলাকার এমপি সাদ্দাম হোসেন পাভেল আমাদের বাড়ীতে এসেছিলেন। তিনি সমাধান করে দিতে চেয়েছেন। আমি বলেছি স্বামী হত্যায় ন্যায় বিচার চাই। আসামীদের ফাসি চাই।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জলঢাকা থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওই ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য আসামীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ময়না তদন্তের রির্পোট পাওয়া যায়নি। রির্পোট পাওয়ার পর প্রয়োজনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।