সৈয়দ বোরহান কবীর
টানাপোড়েন এবং শঙ্কার মধ্যে বিদায় নিচ্ছে ২০২২। কাল ২০২৩-কে বরণ করে নেবে বিশ্ব। নানা কারণেই ২০২৩ সাল শুরুর আগেই আলোচনায়। জাতিসংঘ ২০২৩-কে একটি দুর্যোগপূর্ণ বছর হিসেবে ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘ ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক মহামন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। জাতিসংঘের ঘোষণার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, আগামী বছর বিশ্ব এক কঠিন সময় পার করবে। বাংলাদেশেও শঙ্কার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। প্রবল ঝড় শুরুর আগে যেমন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা তেমনি। একটা গুমোট পরিবেশ অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে। প্রধানমন্ত্রী কয়েক মাস আগে থেকেই ২০২৩-এর প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশবাসীকে। অর্থনীতিতে তেমন কোনো সুখবর নেই। রাজনীতিতেও অস্থিরতার পদধ্বনি। এরকম শঙ্কার মধ্যেই ২০২৩-কে বরণ করে নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব।
একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ২০২৪-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। এমনটি বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরের জনসভা থেকে ভোট চাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত করার উদ্যোগও তিনি গ্রহণ করেছেন। নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ জাতীয় কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলেছে গত ২৪ ডিসেম্বর। চমকহীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে পুরনো নেতৃত্বের প্রতিই আস্থা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। নেতৃত্বের পরিবর্তন করে শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। প্রায় পরিবর্তনহীন নতুন নেতৃত্ব বিরোধী আন্দোলন এবং নির্বাচন কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই সামনে দেখার বিষয়। তবে ২০১৮-এর নির্বাচনে ‘অলৌকিক’ বিজয়ের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। সেই ধারা ২০২২-এর শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অতি আত্মবিশ্বাসের কারণেই ২০১৯ সালের মন্ত্রিসভায় ১৪ দল বা মহাজোটের কাউকে নেয়নি আওয়ামী লীগ। মহাজোট নেই, ১৪ দলও এখন কেবল কাগজ-কলমে জীবিত। বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক এ জোট আইসিইউতে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। ১৪ দলকে চাঙা করার কোনো উদ্যোগও দেখা যায় না, বরং আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এদের এতিম, উদ্বাস্তু মনে করেন। ভাবখানা এমন, একটু ত্রাণ পেলেই এরা আবার কাছে আসবে। এবার কাউন্সিলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাস দেখা গেল। এ কারণেই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন করেনি। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতার সঙ্গে কথা বললে, তাদের বেশ হালকা এবং চিন্তাহীন মনে হয়। তারা মনে করেন, ২০১৪ কিংবা ২০১৮-এর মতো আবার আওয়ামী লীগ জয় পাবে। টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা। বিএনপি নির্বাচনে আসুক না আসুক, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কেউ ঠেকাতে পারবে না, এমন একটি বদ্ধমূল ধারণা আওয়ামী লীগের ডাকসাইটের নেতাদের মধ্যে। বিরোধী দলকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তৃণমূলের ত্যাগী পরীক্ষিতদের পাত্তা না দেওয়ার এক উদাসীনতা আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে দৃশ্যমান। শুধু উদাসীনতা নয়, বিরোধী মতকে শায়েস্তা করার এক উগ্র মানসিকতাও আওয়ামী লীগের পাতিনেতাদের পর্যন্ত পেয়ে বসেছে।
একজন প্রবীণ নাগরিক কদিন আগে সরকারবিরোধী এক লিফলেট বিলি করছিলেন। হঠাৎ আওয়ামী লীগের এক পাতিনেতা তাকে চড় মেরে বসলেন। এ ধরনের অযাচিত মাস্তানি আওয়ামী লীগের আদর্শ নয়। কিন্তু পাতিনেতার ওই চড়কাণ্ডের প্রতিবাদ করেননি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা। আওয়ামী লীগের অনেকের মধ্য থেকে ‘বিনয়’ উবে গেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতা চিরস্থায়ী। কেউ কোনো দিন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। কীভাবে আওয়ামী লীগ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসবে? এরকম প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগের শতভাগ নেতা একটাই উত্তর দেন ‘শেখ হাসিনা কিছু একটা করবেন।’ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা গত ১৪ বছরের উন্নয়ন জনগণের সামনে ঠিকঠাক মতো বলতে পারেন না। খুব কমসংখ্যক নেতাই শেখ হাসিনার মতো বিনয়ী। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার তাগিদও নেই বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে। জনগণ তো দূরের কথা, দলের তৃণমূলের কর্র্মীদের এখন ঝামেলা মনে করেন নেতারা। দেখা-সাক্ষাৎ তো দূরের কথা, গ্রামের একজন কর্মীর ফোনটা পর্যন্ত ধরেন না অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। এসব এলিট নেতা মনে করেন, শেখ হাসিনা একাই সব দুর্যোগ সামাল দেবেন। একাই আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনবেন। এই চিন্তা তাদের মগজে প্রোথিত হয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচনের পর। কিন্তু শেখ হাসিনা যদি একাই সব করবেন, তাহলে এত মন্ত্রী, এত নেতা, এত সংসদ সদস্যের কাজ কী? দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কজন মন্ত্রী, নেতা কী করছেন? শেখ হাসিনা ছাড়া জনগণের কাছে আস্থাভাজন আর কজন আছেন? এ প্রশ্নগুলো আগামী বছর সামনে আসবেই। এ প্রশ্নের মুখোমুখি আওয়ামী লীগকে হতেই হবে। না হলে আওয়ামী লীগকে ২০২৩ সালে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।
রংপুরে ২৭ ডিসেম্বর যে ‘লজ্জা’ আওয়ামী লীগ পেয়েছে, সামনে তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া চতুর্থ হয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নয়, ইসলামী আন্দোলন। ’৭৯ সালে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগও রংপুরে এমন দুর্দশার মধ্যে পড়েনি। ’৭৯ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এরকম বাজে ফলাফল করেনি। সামরিক একনায়ক জিয়ার ইচ্ছাপূরণের ওই নির্বাচনে বৃহত্তর রংপুর জেলায় আসন ছিল মোট ২৩টি। ব্যাপক কারচুপির পরও আওয়ামী লীগকে ৪টি আসনে পরাজিত করতে পারেনি সামরিক স্বৈরাচার জিয়া। বাকি ১৯টি আসনেও আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় হয়েছিল। এরশাদ ক্ষমতায় এসে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করেন। ১৯টি জেলা বেড়ে ৬৪টি হয়। ১৯৮৬ সালের ৭ মে এরশাদের অধীনে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে রংপুরে আসন ছিল ৬টি। ব্যাপক কারচুপি করেও এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩টি আসনে আওয়ামী লীগের কাছে হেরে যায়। রংপুর-২ আসনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনিসুল হক চৌধুরী। রংপুর-৪ আসনে শাহ আবদুর রাজ্জাক এবং রংপুর-৫ আসনে এইচ এন আশিকুর রহমান। ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতিতে রংপুর ছিল আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর শ্বশুরবাড়ি হওয়ার কারণে দলটির প্রতি আলাদা আবেগ এবং ভালোবাসা কাজ করে রংপুরবাসীর। ’৯০-এ এরশাদের পতন এবং তাকে গ্রেফতারের পর রংপুরের রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে যায়। যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগ প্রবল হয়ে ওঠে। ‘রংপুরের ছাওয়াল’কে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট দেন রংপুরবাসী। সেই থেকে রংপুর এরশাদের ঘাঁটি। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। কিন্তু রংপুরে জাতীয় পার্টির পর আওয়ামী লীগ শক্তিশালী। রংপুরের একটি আসন থেকে (পীরগঞ্জ) স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী নির্বাচিত। অন্য একটি আসন থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংসদ সদস্য হয়েছেন। গত ১৪ বছরে রংপুরে যে উন্নয়ন হয়েছে এরশাদের ৯ বছরে তার সিকি পরিমাণও হয়নি। রংপুরে দুই হেভিওয়েট নেতা সংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি। চাটুকার, তোষামোদকারী এবং সুযোগসন্ধানীরা সংগঠনকে কুরে কুরে খেয়েছে। নতুন নেতৃত্ব বিকশিত হয়নি। তার ফল রংপুরের লজ্জা। সিটি নির্বাচনে চতুর্থ হওয়া।
আমি জানি, সব কিছুকে অবজ্ঞা করা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলবেন, এতে কী আসে যায়। এই নির্বাচন তো আমরা জাতীয় পার্টিকেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। রংপুর সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে, সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আন্তরিক। ইত্যাদি নানা কথার মারপ্যাঁচে আসল সমস্যা আড়ালের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু রংপুরের ফলাফল নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। কেন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি রংপুরে জামানত হারাল। লজ্জায় ডুবল। রংপুরের ভরাডুবির সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য ময়নাতদন্ত যদি আওয়ামী লীগ না করে তাহলে ২০২৩ সালে তাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে। রংপুরের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। মিলন এবং ডালিয়ার ভোট যোগ করলে রংপুরে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় হয়েছে। (৫৬ হাজার ভোট)। কাজেই আওয়ামী লীগ বিভক্ত ছিল এ জন্যই এই ভরাডুবি। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই বিভক্তি কি কেবল রংপুরে?
না, এই বিভক্তি সারা দেশে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সারা দেশে আওয়ামী লীগের বিভক্তির প্রকাশ্য ভয়ংকর রূপ দেখেছেন দেশবাসী। আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। ঘাতক। মন্ত্রী এবং এমপিরা ‘মাই ম্যান’কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। আবার কোথাও অযোগ্য বিতর্কিত প্রার্থী মনোনয়নের প্রতিবাদে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাই প্রাণের প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। আওয়ামী লীগের বিগত কমিটি এই বিদ্রোহ দমনে সীমাহীন ব্যর্থতা এবং অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছিল, যারা নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হবে তাদের ক্ষমা নেই। আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু কাউন্সিলের আগেই তাদের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কোনো অপরাধ না- এই বার্তাটা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। যে কারণেই মিলন রংপুরে দাঁড়িয়েছেন। নিশ্চয়ই দলে তার গডফাদার আছে। বিভক্ত এই আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে কী করবে? রংপুরের নির্বাচনের পর এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এবার কাউন্সিলের আগে উৎসাহী ছিলেন। আশাবাদী ছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, নতুন নেতৃত্ব আসবে। তৃণমূলের সমস্যা ও সংকটের বিষয়গুলো বলার একটা জায়গা হবে। হাইব্রিড এবং অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে চিড়েচ্যাপ্টা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ তাদের দুঃখগুলো বলার একটা জায়গা পাবে। কিন্তু পুরনো নেতৃত্ব কেন্দ্রে যেমন পুনর্বহাল হয়েছে, তেমনি অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড, আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত রাজাকারদের সঙ্গে ত্যাগী, পরীক্ষিত, দুঃসময়ের লড়াকুদের বিরোধকেও অব্যাহত রাখা হয়েছে কাউন্সিলে। আগামী এক বছর এই বিরোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে? আওয়ামী লীগের কজন নেতা খবর রাখেন ’৭৫-এর প্রতিবাদ যোদ্ধারা অনেকেই নীরবে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্যাতিত অনেক আওয়ামী লীগ কর্মী এখনো হতাশায় কাঁদেন। যে জামায়াত-শিবির তাদের ঘর পুড়িয়েছিল, তারাই এখন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। এক-এগারোর সংস্কারপন্থি নেতা যখন প্রেসিডিয়ামে পুনর্বাসিত হন। তখন তাকে ধাওয়া দেওয়া কর্মীরা পালাবে কোথায়? এই কাউন্সিল আওয়ামী লীগে সংক্রমিত অন্তঃকোন্দল ব্যাধি সরানোর পথ খুঁজতে পারেনি। বরং ক্ষতকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। আগামীতে এর জন্য আওয়ামী লীগকেই মাশুল দিতে হবে।
রংপুরের নির্বাচন আরেকটি বিষয়কে সামনে এনেছে। যে কোনো নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা জরুরি। হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়াকে যখন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, তখনই অনেকে বলেছেন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে রংপুর সিটি করপোরেশন উপহার দেওয়ার জন্যই এমন প্রার্থী দিয়েছে। ২০১৮-এর নির্বাচনের পর প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা শুরু হয়। যাকে খুশি মনোনয়ন দিলেই হলো। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো, ওই প্রার্থী বিনা ভোটে অথবা জোর করে জিতে আসবেন। এমন একটা প্রবণতা আওয়ামী লীগের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধা উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চমকে দেয়। এ উপনির্বাচন বাতিল করে কমিশন। এটি ছিল নির্বাচন কমিশনে সুস্পষ্ট বার্তা। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি না সেটি পরের বিষয়। কিন্তু ২০২৪-এর নির্বাচন যে ’১৪ বা ’১৮-এর নির্বাচনের মতো হবে না সেই সংকেতটি কিন্তু আউয়াল কমিশন দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভালো করেই জানেন, কোন এমপির কী অবস্থা। কোনো এমপির ভোট চাইতেও এলাকায় যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই, এটা সবাই জানে। কোন সংসদ সদস্য নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন, টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন, সে খবর এখন গোপন নেই। তাই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগা আওয়ামী লীগ এখন পরিবর্তনবিমুখ। ২০১৯ সালের মন্ত্রিসভায় বড় পরিবর্তন হয়নি। এই মন্ত্রিসভায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে সীমাহীন অযোগ্যতার অভিযোগ সর্বজনবিদিত। এই মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্যের দুর্নীতির ফিরিস্তি আরব্য রজনীর গল্পের মতোই অন্তঃহীন। তবুও তারা মন্ত্রিত্ব হারাননি। কারণ আওয়ামী লীগ ঝুঁকি নেয়নি। বিরোধীদের সমালোচনার সুযোগ করে দিতে চায়নি। কাউন্সিলের আগে জেলা পর্যায়ের সম্মেলনগুলোতে আওয়ামী লীগ ছিল পরিবর্তনবিমুখ। কাউন্সিলেও আওয়ামী লীগ পরিবর্তনের দরজা বন্ধ রেখেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ পরিবর্তনকে স্বাগত না জানায় তাহলে বড় ঝুঁকিতে পড়বে।
রংপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, সঠিক প্রার্থী না হলে কর্মীরাও তার পেছনে দাঁড়াবে না। নতুন বছরে আগামী নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই ক্ষমতাসীন দলের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ কীভাবে মোকাবিলা করবে। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক না করুক, আওয়ামী লীগকে একটি কঠিনতম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থাকে, তাহলে বুঝতে হবে বিএনপি একা নয়, বিএনপির পেছনে রয়েছে কিছু পশ্চিমা দেশ, সুশীল সমাজ এবং প্রভাবশালী গণমাধ্যম। বিএনপি যদি নির্বাচন না করে তাহলে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার নির্বাচিত হওয়ার স্বপ্ন যারা দেখছেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ২০২৩ সাল হবে স্কুইড গেমের বছর। মরো অথবা মারো। কাজেই বিএনপিকে উপেক্ষা করা, যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার প্রবণতাগুলো কমাতে হবে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি একইভাবে হয় না। বাংলাদেশে আর কখনো ২০১৪-এর মতো নির্বাচন হবে না।
শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে, তাহলেও কঠিন লড়াই করতে হবে আওয়ামী লীগকে। ২০২৪-এর নির্বাচন ২০১৮-এর মতো হবে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে, তা তো গাইবান্ধায় তারা দেখিয়েছেন। আর অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরিণতি রংপুরের মতো হওয়াটাও অসম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশকে পাল্টে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এই তো বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) মেট্রোরেলের স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো। ২০০৮ সালে কে ভেবেছিল বাংলাদেশে মেট্রোরেল হবে, পদ্মা সেতু হবে, কর্ণফুলী টানেল হবে। এই উন্নয়নের রূপকার শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের স্বপ্নের সীমাকে অবারিত করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি শেখ হাসিনার প্রতি ন্যায়বিচার করেছে? আওয়ামী লীগের শুধু নয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদের নাম শেখ হাসিনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যর কারণে এই সম্পদকে আমরা অবহেলায় নষ্ট করছি। আওয়ামী লীগের একটি অংশ যেন শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করার মিশনে নেমেছে। এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। শেখ হাসিনার কারণেই আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায়। তাই শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করতে হবে। তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁর নির্দেশগুলো পালন করতে হবে। ২০২৩ সালে বর্তমান সরকার, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগকে হাঁটতে হবে কাঁটা বিছানো পথে। অহংকার আত্মতুষ্টি আর প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা করার পরিণাম কী হয় তা অতীতে আওয়ামী লীগের চেয়ে কেউ ভালোভাবে দেখেনি। ২০২২-এ রংপুরে সেই সতর্কবার্তাই পেল আওয়ামী লীগ।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com