সেলিম হোসাইন আজাদী: শুদ্ধ রোজার জন্য চাই বিশুদ্ধ জ্ঞান। আজ তাই আলোচনা করব রোজার বুনিয়াদি কয়েকটি মাসায়েল সম্পর্কে। সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মাহে রমজান পাবে সে যেন সিয়ামব্রত করে।’ এ আয়াতের আলোকে ইসলামি আইনবিদরা বলেন, প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের ওপর রোজা ফরজ (ফাতাওয়া হিন্দিয়া প্রথম খ , পৃষ্ঠা-১৯৫; রদ্দুল মুহতার দ্বিতীয় খ , পৃষ্ঠা-৩৭২)।
রোজা রাখতে হলে নিয়ত করতে হয়। নিয়ত করা ফরজ। আরবি নিয়ত অর্থ সংকল্প বা ইচ্ছা করা। রোজা রাখতে ইচ্ছুক ব্যক্তি মনে মনে এ সংকল্প করবে, ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আগামী কালের রোজা রাখছি।’ নিয়ত মুখে বলা জরুরি নয়। তবে ফকিহরা মুখে বলা মুস্তাহাব বলেছেন। বুখারির বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’ (বাদায়েউস সানায়ে, দ্বিতীয় খ , পৃষ্ঠা-২২৬)। ফকিহরা বলেন, মাহে রমজানের রোজার নিয়ত রাতেই করা উত্তম। সুনানে আবু দাউদে উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের আগে রোজা রাখার নিয়ত করবে না তার রোজা পূর্ণাঙ্গ হবে না’ (আলবাহরুর রায়েক দ্বিতীয় খ , পৃষ্ঠা-২৫৯)।
তবে যদি রাতে নিয়ত করা সম্ভব না হয় তাহলে দিনে সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোজা হয়ে যাবে। সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বলেন, আশুরার রোজা যখন ফরজ ছিল তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে ঘোষণা করতে বললেন, ‘আজ আশুরার দিন! তাই যে সকাল থেকে কিছু খায়নি সে বাকি দিন রোজা রাখবে। আর যে খেয়েছে সেও বাকি দিন খাওয়া থেকে বিরত থাকবে।’ (বুখারি।) একবার কিছু লোক সকালে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য নিয়ে ওমর ইবনে আবদুল আজিজের (রহ.) কাছে এল। তারা বলল, গতকাল সন্ধ্যায় আমরা মাহে রমজানের চাঁদ দেখেছি। এ কথা শুনে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ঘোষণা করলেন, ‘যে সকাল থেকে কিছু খায়নি সে বাকি দিন রোজা রাখবে। আর যে খেয়েছে সেও বাকি দিন না খেয়ে রোজার মতো কাটিয়ে দেবে’ (আল মুহাল্লা, চতুর্থ খ , পৃষ্ঠা-২৯৩)।
প্রতিটি রোজার নিয়ত আলাদা আলাদা করতে হবে। একত্রে পুরো মাসের রোজার নিয়ত করলে তা যথেষ্ট হবে না (মাবসুত, তৃতীয় খ , পৃষ্ঠা-৬০)। রাতে রোজার নিয়ত করলেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-মিলনের জায়েজ। এতে নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, রমজানের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে (সুরা বাকারাহ, আয়াত-১৮৭)। নিয়তের সময় শুরু হয় আগের দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে। যেমন বৃহস্পতিবারের রোজার নিয়ত বুধবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে করা যায়। বুধবার সূর্যাস্তের আগে বৃহস্পতিবারের রোজার নিয়ত করা যথেষ্ট নয় (আল মুহিতুল বোরহানী তৃতীয় খ , পৃষ্ঠা-৩৪৩)। সাহরি খাওয়া সুন্নত। পেট ভরে খাওয়া জরুরি নয়, এক ঢোক পানি পান করলেও সুন্নত আদায় হবে। মুসলিম শরিফের হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সাহরি খাওয়া বরকতপূর্ণ কাজ। সুতরাং তোমরা সাহরি না খেয়ে রোজা রেখো না। এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহরি খেয়ে নিও। যারা সাহরি খায়, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’
ফিকহের কিতাবে লেখা আছে, সুবহে সাদিকের কাছাকাছি সময় সাহরি খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা মাকরুহ যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। মুজামুল আওসাতে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দ্রুত ইফতার করা এবং দেরি করে সাহরি খাওয়া পূর্ববর্তী সব নবীর সুন্নত। মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাকে আমর ইবনে মায়মুন আল আওদি (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘সাহাবিরা দ্রুত ইফতার করতে এবং দেরি করে সাহরি খেতে পছন্দ করতেন।’
সূর্যাস্তের পর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা সুন্নাত। বুখারির বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যতদিন মানুষ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে।’ এ ক্ষেত্রে মাগরিবের নামাজের আগে ইফতার করা সুন্নাত। খাদেমুর রাসুল আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মাগরিবের নামাজ পড়ার আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর খেতেন। আর তাও না পেলে এক ঢোক পানি খেয়ে ইফতার করতেন’ (সুনানে তিরমিজি)।
খেজুর দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার কাছে খেজুর আছে সে খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা পানি পবিত্র।’ (সুনানে তিরমিজি।)
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট
পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com