নিউজ ডেস্ক: এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করলেও দাবি আদায় হওয়ার পরপরই প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এই দুটি দল হঠাৎ কেন এই দ্বন্দ্বে জড়ালো সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
সম্প্রতি এই দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে ওঠে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের দুইটি স্ট্যাটাস ঘিরে।
ওই দুইটি স্ট্যাটাসের মধ্যে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে সেটি 'সরিয়ে ফেললেও' অনলাইনে তার স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। ।
উপদেষ্টা মাহফুজের পোস্টের পর এ নিয়ে এনসিপি ও তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতাদের অনেককে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিতে দেখা গেছে।
একই সাথে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কর্মসূচিতে গোলাম আযমের নামে স্লোগান দেওয়া নিয়ে সমালোচনা করতেও দেখা গেছে।
একই মঞ্চে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করা দুটি দল হঠাৎ কেন প্রকাশ্যে বিরোধে জড়ালো; কিংবা এটি বিরোধ নাকি রাজনৈতিক কোনো কৌশল সেই সব প্রশ্ন উঠেছে।
ঘটনাটি শুরু হলো যেভাবে
গত বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয় প্রধান উপদেষ্টার বাস ভবনের সামনে।
ওই রাতেই একে একে আন্দোলনে যুক্ত হয় ছাত্র শিবির, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন।
আন্দোলনের পরিসর রাতেই বড় হলে গভীর রাতে যোগ দেয় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ দলটির শীর্ষ নেতারা।
এই কর্মসূচিতে জনসমাগম বাড়তে শুরু করলে পরদিন শুক্রবার বিকেলে অবস্থান কর্মসূচির স্থান পরিবর্তন করে শাহবাগে নিয়ে যাওয়া হয়।
এনসিপির একজন শীর্ষ নেতা বিবিসি বাংলাকে জানান, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জমায়েত কর্মসূচি শাহবাগে স্থানান্তর হওয়ার পর সেখানে ইসলামী ছাত্র শিবির, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কিছু সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বেশি ছিল।
এনসিপির ওই নেতা জানান, শাহবাগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমসহ বেশ কয়েকজন নেতার নাম ধরে বিতর্কিত কিছু স্লোগান ও জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বাঁধা দেয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে সেই বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।
যেহেতু এই আন্দোলনটি এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বেই শুরু হয়েছিল। ওইসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সমালোচিত হয়।
এনসিপির কেন্দ্রীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এনসিপি মধ্যপন্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু যখন অন্য কোন সংগঠনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দায় এসে এনসিপির ওপর পড়ে তখন সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়"।
এ নিয়ে এনসিপির নেতাকর্মীদের অনেকেই এক ধরনের সংকটের মধ্যেও পড়ে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "গণতন্ত্রে মত পার্থক্য থাকবে, কিন্তু সেগুলো কোনভাবেই দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর না হয় সেটা নিশ্চিত করাটা রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্য"।
তিনি বলেন, "একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী বয়ান থেকে যেমন নিস্তার চাই, একই সাথে সেই সময়ের জামায়াতের নেতৃবৃন্দ ও দলগতভাবে জামায়াতের যে অবস্থান সেটার স্পষ্টও ব্যাখ্যা আমরা চাই"।
ক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবির
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি গঠনের পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে জামায়াত শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে অনেককেই সমালোচনা করতে দেখা গেছে।
যদিও গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের এই সংগঠনটি বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছিল।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ বৃহস্পতিবার যে অবস্থান কর্মসূচিতে ডাক দিয়েছিল সেখানে জামায়াত শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকেই অংশ নিতে দেখা যায়।
একই মঞ্চে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সফলতা আসার পর কেন হঠাৎ জামায়াত শিবিরকে ইঙ্গিত করে এই ধরনের পোস্ট দিয়েছে মাহফুজ আলম, সেটি নিয়েও প্রশ্ন জামায়াত ও শিবিরের শীর্ষ নেতাদেরও।
শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ অগ্রসর ভূমিকা পালন করছে। হাসনাত প্রশংসায় ভাসছে। সেখান থেকে দৃষ্টি তার (মাহফুজ আলম) দিকে ফেরাতে হয়তো এমনভাবে লিখেছে। সে জানে এতে বিতর্ক তৈরি হবে, ইন্টেনশনালি সেইদিকে ইন্ডিকেট করছে"।
"অনলাইনে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য করা হচ্ছে। এই জাতীয় কর্মকাণ্ডগুলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকার করেছে", যোগ করেন তিনি।
শাহবাগে গোলাম আযমকে নিয়ে শ্লোগান কিংবা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধার বিষয়গুলো নিয়েও শিবির সেক্রেটারিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "ফেসবুকে স্ট্যাটাস না দিয়ে যারা জাতীয় সংগীতে বাধা দিয়েছে বা অন্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত ছিল"।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বিবিসি বাংলার কাছে প্রশ্ন রাখেন একজন উপদেষ্টা কী একটি রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলেছেন সেটা কী তিনি বলতে পারেন?
তিনি বলেন, "তিনি (মাহফুজ) উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে রাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এটা তার শপথের সাথে সাংঘর্ষিক। কেউ যদি রাজনীতি করতে চায় তার উপদেষ্টা পদ থেকে সরে এসে রাজনীতি করা উচিত"।
এ নিয়ে জামায়াত ও শিবির নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও করেছে। সেখানে কেউ কেউ মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দাবি তুলবে কী-না সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেয়া হয় নি বলে জামায়াত ও শিবিরের নেতারা জানান।
এর আগে গত মার্চে জামায়াত নিয়ে মাহফুজ আলমের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে নানা বিতর্ক দেখা গেছে। সে সময় জামায়াত নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল। খবর-বিবিসি বাংলা