নিউজ ডেস্ক: সদর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশনের ৯ থেকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত রংপুর-৩। স্বাধীনতার পর এই আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একবার করে জয় পেলেও জাতীয় পার্টি দল গঠনের পর থেকে দখলে নেয় আসনটি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে কি না তা নিশ্চিত না হলেও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের ঘরে বইছে নির্বাচনী হাওয়া।
এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থী হিসেবে দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী রংপুর মহানগরের সেক্রেটারি মুহাম্মদ আমিরুজ্জামান পিয়ালের নাম ঘোষণা করে। জোট ছাড়া জাতীয় পার্টি অচল। এখন আওয়ামী লীগ নেই। একটা সময় মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে জাতীয় পার্টিকে ভোট দিতো। এখন সেই আবেগ কেটে গেছে। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেও তেমন একটা ভালো করতে পারবে বলে মনে হয় না।
বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা না করলেও দলটির মহানগরের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক শহর কমিটির সভাপতি কাওছার জামান বাবলা, জেলার সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু, মহানগরের আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে ও মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রিটা রহমানসহ একাধিক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বলে জানা গেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং ১৯৮৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এরমধ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এরশাদ ও তার পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন এই আসনের সংসদ সদস্য।
সিটি করপোরেশন গঠনের পর দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে একবার আওয়ামী লীগের ঘরে মেয়র পদ চলে গেলেও পরপর দুবার জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে। এরপর আর ক্ষমতায় যাওয়া হয়নি জাতীয় পার্টির। তবে ক্ষমতা হারালেও বেশিরভাগ সময়ে ক্ষমতাসীন দলের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সুবিধা ভোগ করেছে দলটি। এনসিপি এখন পর্যন্ত রংপুরে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বাম দলগুলোরও খবর নেই। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি না সেটা নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় নির্বাচন হলে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে লড়াই হবে।
আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকাও পালন করে জাপা। এ কারণে গৃহপালিত বিরোধীদলের তকমাও জোটে কপালে। জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুর অঞ্চলেও প্রভাব কমতে থাকে এক সময়ের একক আধিপত্য বিস্তারকারী দলটির।
বিগত সময়ের বিতর্কিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে শরিক দলের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া আসন ছাড়া এককভাবে কোনো আসনেই সুবিধা করতে পারেনি তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জোট ছাড়া অনেকটা বেকায়দায় পড়েছে জাতীয় পার্টি।
এদিকে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে ও বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন বর্জন করলেও ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। যার প্রমাণ বিগত সময়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পাওয়া যায়।
গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হলেও প্রায় ৫০ হাজার (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) ভোট পেয়ে চমক দেখায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করলে খেসারত দিতে হতে পারে। এর আগে বহিরাগত একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সাধারণ ভোটাররাও তাকে সেভাবে জানতেন না। হুট করে এসে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
এর আগের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীও ভোটের মাঠে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী জোটগত কারণে আগে এই আসন বিএনপিকে ছেড়ে দিলেও এবার নিজেদের অবস্থান জানান দিতে জোরেশোরেই মাঠে নেমেছে।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বাইরে এই আসনে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে লড়াই হতে পারে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা।
রংপুর নগরীর গনেশপুর বকুলতলা এলাকার নতুন ভোটার জায়েদ ইমরান বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত রংপুরে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বাম দলগুলোরও খবর নেই। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি না সেটা নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় নির্বাচন হলে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে লড়াই হবে।
নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, জোট ছাড়া জাতীয় পার্টি অচল। এখন আওয়ামী লীগ নেই। একটা সময় মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে জাতীয় পার্টিকে ভোট দিতো। এখন সেই আবেগ কেটে গেছে। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেও তেমন একটা ভালো করতে পারবে বলে মনে হয় না। ৫৪ বছরের ইতিহাস এবং বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। এ পরিবর্তন জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই হবে। রংপুর-৩ আসনের মানুষ এবার সেই পরিবর্তনের ধারায় জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে রায় দেবেন বলে আশা করছি।
জানতে চাইলে মনোনয়নপ্রত্যাশী রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক শহর কমিটির সভাপতি কাওছার জামান বাবলা বলেন, এর আগে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন কিনেছি। এবার যেহেতু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সংসদ নির্বাচন হতে পারে তাই আমিও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, ‘আমি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। সেই লক্ষ্যে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছি। আশা করছি, সবদিক বিবেচনা করে দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
সাবেক ছাত্রনেতা ও রংপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে একাধিকবার কারাবন্দি ছিলাম। এই এলাকার সাধারণ মানুষের সুখে দুখে সবসময় পাশে থেকেছি। তাদের ভালোমন্দ আমার জানা আছে। তাই মনে করি, দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় তাহলে আমি ভালো করতে পারবো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বিএনপির এক নেতা বলেন, এই আসনে বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করলে খেসারত দিতে হতে পারে। এর আগে বহিরাগত একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। সাধারণ ভোটাররাও তাকে সেভাবে জানতেন না। হুট করে এসে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যার সঙ্গে নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যার সবসময় ওঠাবসা এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল বলেন, নির্বাচনের প্রাথমিক কাজ হিসেবে বিভিন্ন কেন্দ্র ও ওয়ার্ডে কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আমরা বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছি। ৫৪ বছরের ইতিহাস এবং বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তন জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই হবে। রংপুর-৩ আসনের মানুষ এবার সেই পরিবর্তনের ধারায় জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে রায় দেবেন বলে আশা করছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পিয়াল বলেন, এবার মনোনয়ন দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীদের অবস্থান যাচাই করে দেখা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ভালোই সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি ভালো কিছু হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে মোট ভোটার ছিলেন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭, নারী ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৯৪ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার মাত্র দুজন।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে কতজন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন সে তথ্য এখনো জানা যায়নি।