আর্কাইভ  সোমবার ● ১৪ জুলাই ২০২৫ ● ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ১৪ জুলাই ২০২৫
চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার

জুলাইয়ের দিনগুলি: ১৩ জুলাই

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
জুলাইয়ের দিনগুলি: ১৩ জুলাই

সারা দেশের সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
সারা দেশের সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা

সারা দেশ উত্তাল ছিল ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
সারা দেশ উত্তাল ছিল ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে

আসাদুজ্জামান খান : বস্তায় ঘুষ খান

বাবা মন্ত্রী, ছেলে ছায়া মন্ত্রী

সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, রাত ০১:৪৩

Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  আসাদুজ্জামান খান কামাল ১০ বছরের বেশি সময় ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে কামালের ছেলে শাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি হয়ে ওঠেন ‘ছায়া মন্ত্রী’। জ্যোতি নিজেই ছিলেন সন্ত্রাসী। মূলত আওয়ামী লীগ তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গড়ে তুলেছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের ‘দানব বাহিনী’র মাধ্যমে। আওয়ামী নেতাদের ছেলেদের সামনে আনা হয়। তবে তা রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, সন্ত্রাসী মাফিয়া হিসেবে। দ্বিতীয় প্রজন্মের আওয়ামী দানবরা ছিল উদ্যত, হিংস্র, আক্রমণাত্মক। তারা জনগণকে ভালোবাসত না, বরং জনগণের ওপর নিপীড়নই ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেমন আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে জ্যোতি, গাজী গোলাম দস্তগীরের ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পু, শামীম ওসমান, নিজাম হাজারী, হাজী সেলিমের ছেলে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় প্রজন্মের ‘রাক্ষস’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। জ্যোতি ছিলেন এদের সরদার। জ্যোতির নির্দেশে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পগ্রুপকে হয়রানি, জমি দখল, চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চাঁদাবাজি করা হয়। চাঁদা না দিলেই মিথ্যা মামলা দিয়ে শুরু হয় হয়রানি।

বসুন্ধরা মিডিয়া হাউস প্রথম এদের অপকর্মের কাহিনি প্রকাশ করে। সারা দেশে এ দানবদের লুটপাট এবং অত্যাচার-নিপীড়নের সংবাদ প্রথম আনে বসুন্ধরা মিডিয়া। ফলে বসুন্ধরা গ্রুপ জ্যোতি গংদের টার্গেটে পরিণত হয়। ২০১৫ সাল থেকে বসুন্ধরা মিডিয়া ও বসুন্ধরার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। কখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, কখনো বানোয়াট হত্যা মামলা বা অন্য কোনো মিথ্যা মামলা। হয়রানির মাধ্যমে চাঁদা আদায় ছিল জ্যোতি-পাপ্পু বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য। এরা সবাই মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীসহ নানা অপকর্মে জড়িত। শুধু তাই নয়, এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপের উদ্যোক্তাদের গুম করা, ‘আয়নাঘরে’ নিয়ে যাওয়ারও ভীতি দেখানো হয়। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োগ, বদলি ও টেন্ডারবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন আসাদুজ্জামান খানের ছেলে শাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি। মন্ত্রীর বাসায় বস্তায় বস্তায় টাকা প্রবেশের নেপথ্যে কাজ করেছেন জ্যোতি। বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘিরে বাবা-ছেলে মিলে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে বিপুল অবৈধ সম্পদ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু অনপনেয় বা অমোছনীয় কালি কেনার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, এর সঙ্গেও ওই সিন্ডিকেট জড়িত বলে বেরিয়ে এসেছে। কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হন জ্যোতি। রিমান্ডে তিনি পুলিশকে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিচ্ছেন।

সূত্র জানায়, কেবল মন্ত্রণালয় বা এর অধীন প্রতিষ্ঠানেই নয়, বাইরেও দাপট দেখাতেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ছিল জ্যোতির একচ্ছত্র আধিপত্য। ধানমন্ডি এলাকায় কোনো রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে গেলে জ্যোতিকে চাঁদা দিতে হতো। তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিলে অনায়াসেই মিলত রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স। রেস্টুরেন্ট থেকে চাঁদা ছাড়াও কারওয়ান বাজার থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হতো। ফুটপাতে ব্যবসা, বাজার, মাদক ব্যবসায়ী ও আবাসিক হোটেল থেকে উঠত চাঁদা। এ টাকা মন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব ছিল মন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেনসহ আরও দুজনের ওপর। এ টাকার মোটা অংশ পেতেন আসাদুজ্জামান খান কামাল।

পাশাপাশি এ টাকার একটা ভাগ পেতেন তার ছেলে। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ছেলে জ্যোতি, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান এবং একান্ত সচিব মনির হোসেনকে আসামি করে মামলা করেছে দুদক। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এ টাকা আদায় করা হতো। ঘুষ আদায়ে তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তৎকালীন মন্ত্রী। এ সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন ও মন্ত্রীর ছেলে শাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস।

একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন জ্যোতি। ঝুঁকি এড়াতে ঘুষের টাকা পাঠানো হয় দেশের বাইরে। অভিযোগ আছে, জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) নিয়োগে ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা নিত বাবা-ছেলের চক্র। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা আদায় করেছে এ সিন্ডিকেট। ২০২২ সালে একটি মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিয়োগে সিন্ডিকেট সদস্যরা ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে সূত্র জানায়। আরও জানায়, এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের সিন্ডিকেটকে।

নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নিত কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশের এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সিন্ডিকেট এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি গোপন প্রতিবেদন জমা হয়েছে। এ নিয়োগ দুর্নীতিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে পছন্দের তালিকা তৈরি করা হয়। একসময় এসব অর্থ আদায়ের প্রধান দায়িত্ব পান জ্যোতি। তিনি সারা দেশে দ্বিতীয় প্রজন্মের দুর্নীতিবাজদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। যাদের মাধ্যমে পিতার ঘুষ দুর্নীতির রেট আরও বাড়িয়ে দেন। এখন জ্যোতি গ্রেপ্তার হলেও তার বন্ধুরা বেশির ভাগই পলাতক। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরও ২০০ কোটি টাকার বেশি মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ব্যাংকে নগদ অর্থ, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। অনুসন্ধানে তাদের ব্যাংক হিসাবেই শতকোটি টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে। এ ছাড়া তার এপিএস মনিরের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। তিনি আরও বলেন, দুদক টিম ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অন্তত ২০০ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংসংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। তবে তাদের এর চেয়ে বহুগুণ সম্পদ ও মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের অন্য পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়।

মন্তব্য করুন


Link copied