নিউজ ডেস্ক: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশি বাধা, জলকামান, সাঁজোয়া যান মোতায়েন এবং ছাত্রলীগের পাল্টা অবস্থান সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন।
সেদিন দুপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে করা হয়। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের একাধিকবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সেদিন কুমিল্লায় পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়েছিল।
রাজধানীর শাহবাগে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যারিকেড, জলকামান ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে পুলিশ। বিকাল ৫টায় শিক্ষার্থীরা পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মেট্রো স্টেশনের নিচে অবস্থান নেন, তখন পুলিশকে পিছু হটতে দেখা যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বাধা অতিক্রম করে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক ভেঙে মিছিল নিয়ে শাহবাগে পৌঁছান। পথে শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, জিরো পয়েন্ট, মৎস্য ভবন এলাকায় একাধিকবার পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব ও নীলক্ষেতে পুলিশের বাধায় পড়েন। এ সময় ছাত্রলীগের একটি মিছিল কাছাকাছি এসে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
অবরোধ চলাকালে আন্দোলনকারীরা ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সেদিন বলেন, হামলা ও ভয়ভীতি সত্ত্বেও আন্দোলন চলবে, যতক্ষণ না জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সব গ্রেডে ৫ শতাংশ কোটা রেখে বাকিটা বাতিল হয়। তিনি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ডাক দেন।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।
কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়
হাইকোর্ট ২০২৪ সালের ১০ জুলাই কোটা বাতিলসংক্রান্ত রায়ের বিবরণ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সরকার প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিসহ উল্লিখিত শ্রেণির কোটা বাড়াতে বা কমাতে পারবে, তবে তিন মাসের মধ্যে নতুন পরিপত্র জারি করতে হবে।
রিটকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী সেদিন জানান, হাইকোর্ট সব কোটা বহাল রাখতে বলেছে, তবে সংশোধনের স্বাধীনতাও রেখেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আপিল বিভাগ কোটা বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছে, ফলে রায় আপাতত কার্যকর নয়।
এর আগে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি হয়েছিল। এরপর পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে সাতজন চাকরিপ্রত্যাশী রিট করেন, যার ভিত্তিতে হাইকোর্ট এই রায় দেয়।
বিভিন্ন শহরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অব্যাহত
১১ জুলাই কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় কাঁদানে গ্যাস, ফাঁকা গুলি ও লাঠিচার্জ করা হয়। এতে পুলিশ, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। পরে কোটবাড়ী এলাকায় মহাসড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন।
চট্টগ্রামে পুলিশের লাঠিপেটার মুখে পড়েও শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হননি। রাজশাহীতে রেল অবরোধ করেন তারা। সিলেটে লাঠিপেটায় আহত হয় অন্তত ২০ জন। খুলনায় বৃষ্টির মধ্যেও বিক্ষোভ চলে। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ মহাসড়কে মিছিল হয়, তবে ছাত্রলীগের বাধায় কিছু কিছু স্থানে আন্দোলন পণ্ড হয়। ভোলা সরকারি কলেজেও ছাত্রলীগের বাধায় আন্দোলন ব্যাহত হয়। পাবনা, বরিশাল, সিলেট ও জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, ১১ জুলাই দেশের নানা প্রান্তে পুলিশের বাধা, হামলার পাশাপাশি ছাত্রলীগের ক্যাডাররাও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।
সরকারের কঠোর প্রস্তুতি
সরকারি সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ১০ জুলাই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে প্রয়োজন হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলন চালিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে, কোনো অশুভ মহল দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারীরা সীমা লঙ্ঘন করেছে। জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ জানান। ৫ আগস্টের পর দুজনই ভারতে পালিয়ে যান।
সরকার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে সরাতে চাপে রেখেছিল। সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, অফিস খোলার দিনে সড়ক অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করবে। ছাত্রলীগকে মাঠে নামানো হয় এবং মধুর ক্যান্টিন ও রাজু ভাস্কর্যে পাল্টা কর্মসূচি দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসনমন্ত্রী এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রীও কঠোর বক্তব্য দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, আন্দোলন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাওয়া হচ্ছে। প্রশাসন ও দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল—যে কোনো মূল্যে আন্দোলন ঠেকানো হবে।
তবে একই সঙ্গে সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছিল, সরকার কোটাব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছিল। আলোচনার পথ খোলা রেখেই আন্দোলন দমনের চেষ্টা চলছিল।