স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ ঢাকার উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় জীবন দিয়ে অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা করেছেন শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব থেকে একচুল না সরা এই শিক্ষিকা এখন দেশের মানুষের চোখে সাহসিকতার প্রতীক। তার আত্মত্যাগে গর্বিত এলাকাবাসী।
নিজ গ্রামে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। নিজ এলাকায় শুধু শিক্ষা নয়, সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখেও পাশে ছিলেন তিনি। তার পূর্বপুরুষদের স্থাপিত বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজটিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে দুই মাস আগে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন তিনি। কিন্তু কে জানতো তার সেই স্বপ্ন- স্বপ্নই থেকে যাবে।
সোমবার (২১ জুলাই) উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস চলাকালে পাশের একটি ভবনে প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ভবনে। ধোঁয়া আর আতঙ্কে চারপাশ যখন হাহাকার, তখনও শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত ছিলেন মাহেরীন। একপর্যায়ে নিজেই আগুনে আটকে পড়েন। শরীরের অধিকাংশ দগ্ধ হয় তার। তাকে গুরুতর অবস্থায় নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নেন হাজারো মানুষ।
মাহেরীন চৌধুরী শিক্ষকতার চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশী সময় পার করেছে নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর চলে যান ঢাকায়। সেখানে যোগদান করেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর(৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর) শিক্ষক ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন। মাহেরিন চৌধুরীর দুই ছেলে পড়াশোনা করছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী সদ্য এসএসসি পাশ করেছে ও ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী নবম শ্রেণীতে পড়ছে। স্বামী মনসুর আলী হেলাল কম্পিউটার প্রকৌশলী। দুই বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহেরীন হচ্ছেন বড়।
তার দাদি মরহুম রওশনারা বেগম ছিলেন জিয়াউর রহমানের মাতা মরহুম জাহানারা খাতুনের আপন বোন।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে দুই মাস আগে জলঢাকা বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন তিনি।
মাহেরিনের চাচা রিকো চৌধুরী উত্তরবাংলাডটকমকে বলেন, দুই বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিল মাহেরিন। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। আর সেই সময় থেকে এলাকার প্রত্যেক মানুষের পাশি থাকতো। ঢাকায় থেকেও এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সহযোগিতা করতেন।
মাহেরিনের ছোট ভাই মুনাফ চৌধুরী উত্তরবাংলাডটকমকে বলেন, ছোটবেলা থেকে বড় আপুকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। বাবা-দাদারা যেভাবে এলাকার মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করতো, বড় আপুও তেমনি ছিলেন। এলাকার সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর রাখতে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর সন্তানের মধ্যে আমাদের দেখেছেন তিনি। আজ আমাদের মাথা থেকে অভিভাবকের হাত সরে গেল। আমরা আবারও এতিম হয়ে গেলাম।
মাহরীন চৌধুরীর প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার উত্তরবাংলাডটকমকে বলেন, প্রত্যেক বছরের দুই ঈদ ও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন মাহেরিন। এসময় এলাকার গরীব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণেও সহযোগিতা করেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।
অপর প্রতিবেশী মোস্তফা আজাদ উত্তরবাংলাডটকমকে বলেন, তিনি একজন সৎ, ভালো মানুষ ছিলেন। বই-খাতা কিনে দিতেন এলাকার শিশুদের। আমরা একজন আদর্শ মানুষকে হারালাম।
বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান উত্তরবাংলাডটকমকে বলেন, দুই মাসে আগে প্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি করা হয় মাহেরিন চৌধুরীকে। সেসময় তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে আমি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেই প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে চাই আমার পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি। জলঢাকা ও নীলফামারী জেলায় যেনো একটি রোল মডেল হয়ে উঠে এই প্রতিষ্ঠানটি।
তিনি বলেন, আমরা কল্পনা করতে পারছি না যে তিনি আমাদের এইভাবে ছেড়ে চলে যাবেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন মানবিক বীর। আমরা শিক্ষক সমাজ তার আত্মত্যাগে গর্বিত ও শোকাহত।
প্রসঙ্গত, সোমবার(২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হয়ে আসে মাহেরিন। সামান্য আঘাতও পায়। কিন্তু ভিতরে আটকা পড়ে থাকা অন্য শিক্ষার্থীদের টানে, তাদের উদ্ধারে তিনি ভিতরে ঢুকে পড়েন। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনকে আগুন থেকে উদ্ধার করেন মাহেরিন চৌধুরী। উদ্ধারে সময় তিনি দগ্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টার পর মারা যায়।