বিশেষ প্রতিনিধি॥রাজধানীর উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী ও মাসুকা বেগমকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এই সম্মাননার বিস্তারিত অতি দ্রুত নির্ধারণ করা হবে।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, বৈঠকের শুরুতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তাদের আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
তিনি আরও জানান, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসাসেবায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ লক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে।

মাহেরিন চৌধুরী:-
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তাঁর মৃত্যু হয়। তার শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল।
ঘটনার পর দিন মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকাল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। এর আগে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গজল আজম জামে মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৪৬ বছর।
পারিবারিক সূত্র মতে, নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়ায় ১৯৭৯ সালের ৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন মাহেরিন চৌধুরী। মরহুম মোহিতুর রহমান চৌধুরী ও ছাবেরা চৌধুরী দম্পতির বড় সন্তান তিনি। তারা দুই ভাই ও দুই বোন। তার দাদা মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরী ছিলেন এলাকার সুনামধন্য জমিদার। মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরীর পিতা মাহফুজার রহমান চৌধুরী বগুলাগাড়ী স্কুলটি নির্মাণ করেছিলেন ১৮১৯ সালে। ১৯৭০ সালে তা বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ নামে স্থাপিত করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী।
২০০৮ সালে শরীয়তপুর নড়িয়া উপজেলার চর আত্রাই গ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মনছুর হেলালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের রয়েছে দুই ছেলে সন্তান। এর মধ্যে বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও-লেভেল শেষ করেছে। আর ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী ও-লেভেল পরীা দেবে। মেহেরিনের বাবা মোহিতুর রহমান চৌধুরী ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ও মা ছাবেরা চৌধুরী ২০২০ সালের ৩০ জুন মারা যান।
তিনি ১৯৯৫ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন। মাহেরীন চৌধুরী শিক্ষকতার চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশী সময় পার করেছে নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর চলে যান ঢাকায়। চাকুরিতে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর(৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর) সিনিয়র শিক্ষিকা ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন।
পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া স্মৃতি বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজটিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের এডহক কমিটির সভাপতি হন মাহেরীন।

মাসুকা বেগম:-
ওই বিমান বিধ্বস্তের দূর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অপর শিক্ষিকা মাসুকা বেগম নিপু। সেসময় তিনি ক্লাসে ছিলেন। পরে দগ্ধ অবস্থায় তাকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দিনেই রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাসুকার কণ্ঠনালিসহ শরীরের ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হয়। মঙ্গলবার(২২ জুলাই) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুরে বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয়। বাদ আসর জানাজা শেষে সোহাগপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
নিহত মাসুকা বেগম ওরফে নিপু (৩৮) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা চিলোকুট গ্রামের চৌধুরী বাড়ির সিদ্দিক আহমেদের মেয়ে। তবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা জেলা শহরের মেড্ডা সবুজবাগ এলাকায় থাকেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাসুকা সবার ছোট। তাঁর মা মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। বড় বোন পাপড়ি রহমানের শ্বশুরবাড়ি আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুরে। বড় ভাই থাকেন বিদেশে।
পরিবারের সকলের খুব আদর ও স্নেহের ছিল মাসুকা। ছোট থেকে মেধাবী ও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রায় আট বছর আগে মাসুকা রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিন বছর আগে সেখান থেকে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যোগদান করেন তিনি। সেখানে প্রাইমারি শাখার বাংলা ভার্সনে ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন মাসুকা। মা মারা যাওয়ার পর বাবাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল মাসুকা। বলতে গেলে বড় বোন ও বড় দুলাভাই ছিল মাসুকা বেগমের অভিভাবক। তারা মাসুকার বিয়ের জন্য চেস্টা করেছিলেন। কিন্তু সে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কারন অসুস্থ বাবার ভরন পোষন চালাতেন তিনি। বিয়ে করলে বাবার দেখা শোনা কে করবে এমন চিন্তা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। বাবা, বোন ও দুলাভাই তার বিয়ের চেষ্টা করেছি কয়েকবার। কিন্তু বিয়ের প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। সে তার শিক্ষার্থীদেরকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতো।
নিহত মাসুকার বাবা সিদ্দিক আহমেদ বলেন, ১৫ বছর আগে মাসুকার মা মারা যায়। শিকতা ও আমাদের সংসারের জন্য সে আর বিয়ে করতে চায়নি। প্রতি মাসে টাকা পাঠাত। এত অল্প বয়সে মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে,কখনো ভাবিনি।
মাসুকা বেগমের দুলাভাই আশুগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. খলিলুর রহমান জানান, মৃত্যুর আগে হাসপাতালে পাশের বেডে চিকিৎসাধীন আরেক শিক্ষককে মাসুকা তার মৃত্যু হলে যেন তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সোহাগপুরে কবর দেয়া হয় এ অসিয়ত করে যান। সে অনুযায়ী আশুগঞ্জের সোহাগপুর ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে ওই গ্রামের প্রধান কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।