বেরোবি প্রতিনিধি: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয়জন উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগ পেয়েছেন। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই কোনো না কোনো মামলার আসামি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো বিতর্ক না থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় মাত্র সাত মাসের মধ্যে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয়জন উপাচার্য এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য ছিলেন ড. মো. লুৎফর রহমান। তিনি প্রশাসনিক সুশাসন, নিয়মনীতি ও স্বচ্ছতার পক্ষে ছিলেন কঠোর অবস্থানে। তিনি সাত মাসের মধ্যে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ড. আব্দুল জলিল মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতির মামলার আসামি করা হয় তাকে। ২০১৭ সালের ২০ জুলাই রংপুরের একটি আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে নিয়োগ প্রদান ও কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়ে মামলা করে দুদক। প্রায় চার বছরের দায়িত্বকালের পর ২০১৩ সালের ৪ মে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে গোপনে কানাডায় চলে যান তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
তৃতীয় উপাচার্য এ কে এম নুর উন নবী এবং চতুর্থ উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ দুজনের বিরুদ্ধেই অনিয়ম, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ অপব্যবহারের তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। গত ১৮ জুন দুর্নীতির মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এই দুই উপাচার্য, প্রকৌশলী ও ঠিকাদারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা যায়, প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপি উপেক্ষা করে নকশা পরিবর্তন ৩০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের চুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই সম্পাদন এবং নিরাপত্তা জামানতের টাকা এফডিআর হিসেবে ব্যাংকে জমা রেখে ঋণ প্রদানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার করা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন অধ্যাপক কলিমউল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন কেলেঙ্কারির জন্য আলোচিত ছিলেন এই উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি প্রকল্পের চুক্তিতে অগ্রিম অর্থ প্রদানের কোনো বিধান না থাকলেও ঠিকাদারকে ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে অগ্রিম চার কোটি টাকার বিল প্রদান করা হয়। অথচ বিল সমন্বয়ের আগেই গ্যারান্টি অবমুক্ত করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নকশা উপেক্ষা করে দ্বিতীয় পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়, যা সরকারি ক্রয় বিধিমালার লঙ্ঘন। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় মামলা হয়।
এদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মামলায় বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সকালে মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে অধ্যাপক কলিমউল্লাহকে স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। অপর দিকে অধ্যাপক নুর উন নবীকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
বিশ্ববিদ্যালয়টির পঞ্চম উপাচার্য ড. মো. হাসিবুর রশিদ। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন। দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাকে প্রধান আসামি করে ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ ও বর্তমান উপাচার্য ড. শওকাত আলীর। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়োগ পরীক্ষায় আড়াই হাজার খাতা সৃজন, টেম্পারিং ও জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা। গত বছরের ১৫ জুন দুদকের করা মামলায় ড. শাওকত আলী ছাড়াও আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
অধ্যাপক শওকত আলীর বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে খাতা প্রণয়ন এবং অফিসিয়ালি সরবরাহ করা উত্তরপত্র বর্তমানে থাকা উত্তরপত্র দ্বারা কোনো এক পর্যায়ে প্রতিস্থাপিত করার অভিযোগ আনা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭ (ক) ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা করা হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ইস্যুতে তার বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শামিম বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আসলে ক্যারিয়ার নিয়ে আর ফিরতে পারেন না। কিছু দুর্নীতিবাজ লোককে উপাচার্য করা হয়। আবার কিছু উপাচার্য এখানে আসার পরে দুর্নীতে জড়িয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে উদাসীন। দুর্নীতি হলেও তারা কোনো প্রতিবাদ করেন না। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালোভাবে চলুক, এগিয়ে যাক গবেষণা ও মানোন্নয়নে।’
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সিয়াম আহমেদ বলেন, ‘সব উপাচার্য শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবেন, শিক্ষার্থী নিয়ে নন। যতজন উপাচার্য এসেছেন, দুয়েকজন বাদে সবাই কিন্তু ভালো ক্যারিয়ার নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু যাওয়ার সময় প্রত্যেকে আসামি হয়েছেন, ক্যাম্পাস ছেড়েছেন পেছনের দরজা দিয়ে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একের পর এক উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধেও রয়েছে জালিয়াতির অভিযোগ। একজন উপাচার্য মেয়াদ শেষ করতে পারেনি, আরেকজন জেল খেটেছেন। আজ একজন উপাচার্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, অন্য আরেকজন পলাতক। এ ছাড়া একজনকে আদালত দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের। আমি বিশ্বাস করি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও শিক্ষাবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলবে। তিনি যদি দলীয় প্রভাব ও ভ্যন্তরীণ চাটুকারিতার রাজনীতি এড়িয়ে যোগ্যতা ও নীতিনৈতিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে বেরোবি একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে পারে। আমাদের শিক্ষক সমাজ এ ধরনের উদ্যোগে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। তবে আমরা এ রকম কোনো লক্ষণ এক বছরে তার মধ্যে খেয়াল করিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক বলেন, প্রতিটি ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা উপাচার্য বদল হতে দেখেছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিপরায়ণ কাঠামো বদলায়নি। প্রতিশ্রুতি ছিল অনেক, বাস্তবায়ন হয়েছে অল্পই।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, বর্তমান উপাচার্য ড. শওকাত আলী এসব কলঙ্কিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্রবান্ধব এবং জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন গড়ে তুলুন। যেন ছাত্ররা আন্দোলন নয়, শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন আর কখনো কারও রক্তপাত না হয়। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করাই হবে নতুন প্রশাসনের প্রধান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী বলেন, ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত হয়েছি। একজন শিক্ষক, একজন প্রশাসক ও একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আমি অত্যন্ত ব্যথিত, লজ্জিত এবং চিন্তিত যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একাধিকবার প্রশাসনিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এমনকি মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় একটি পবিত্র জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র—এখানে কোনো ধরনের অন্যায়, অপশাসন বা জবাবদিহি কখনোই স্থান পেতে পারে না। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, কোনো ধরনের দুর্নীতি, পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত, বা রাজনৈতিক প্রভাব এখানে বরদাশত করা হবে না। আমি একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও মানবিক প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছি।’
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়াম্যান অধ্যাপক এস এম এস ফায়েজকে মুঠোফোনে কল করলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে কল কেটে দেন। পরে তাকে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।