নিউজ ডেস্ক: কালের স্রোতে হারিয়েছে রেডিওর জৌলুস। এখন আর রেডিওর শব্দে মুখরিত হয় না শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের বাড়ি-ঘর। রেডিওর খবর, গান, নাটক কিংবা গল্প কথায় এখন আর শ্রোতার মন ভরে না। সকালে ও সন্ধ্যায় রেডিও শোনার পারিবারিক সংস্কৃতি এখন ধূসর হয়ে গেছে। গ্রামের বাজারগুলোয় রেডিওতে ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের ধারাভাষ্য শোনার সেই ভিড়ও এখন অচেনা।
কালের চাকা ঘুরে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় সেই রেডিও যেন হারিয়ে গেছে।
তবে রেডিওতে নতুন মাত্রা যোগ হয় ২০০৬ সালে। তৎকালীন কিছু বেসরকারি এফএম রেডিও (রেডিও টুডে, এবিসি রেডিও, রেডিও ফুর্তি) তখনকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু তা ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং সীমিত। মোটামুটিভাবে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল এফএম রেডিওর সোনালি সময়।
এমন একটা সময় পার করছিল তখনকার প্রজন্ম, ঢাকা থেকে শুরু করে সব জেলার মানুষ তার পছন্দের গান শোনার জন্য রেডিওতে অপেক্ষা করত। কাজ করতে করতে, পথ চলতে চলতে কানে দেখা যেত হেডফোন। তখন নতুন গানগুলো প্রথমে রেডিওতেই মুক্তি পেত। হাজার হাজার শ্রোতা মেসেজ করে অনুরোধ করতেন তাদের প্রিয় শিল্পীর গান বাজানোর। সে সময়ে এতটাই এফএম রেডিওর জয়জয়কার ছিল, যে মানুষ তাদের গাড়ির সিডি প্লেয়ারের জায়গায় রেডিও বসিয়ে নিত। আর উন্মাদনার কেন্দ্রে ছিলেন আরজেরা (রেডিও জকি)। ভক্তদের সঙ্গে তাদের অনেক মজার গল্প, যা তারা স্মৃতির ভাণ্ডারে রেখেছেন পরম যতেœ।
কিন্তু বর্তমানে ইউটিউব, পডকাস্ট, ফেসবুক লাইভের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণ প্রজন্মকে এফএম রেডিও থেকেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শ্রোতা কমার ফলে রেডিও স্টেশনগুলো কনটেন্টে রূপান্তর এনে বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকার পথ খুঁজছে, সাংবাদিকতার গুণমান বজায় রাখা সেখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।
এরই মধ্যে কয়েকটি এফএম রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে টিকে থেকে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েকটি রেডিও স্টেশন। মূলত, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল নাগাদ রেডিওতে বিজ্ঞাপন অনেক কমে যায়। এখন নেই বললেও চলে। আগে গানের অনুরোধ বা কোনো কিছুর জন্য মেসেজ আসত না, বরং রেডিও কতৃপক্ষের নিজেদেরই মেসেজ পাঠাতে হতো। ফেসবুকে এসে শ্রোতার কমেন্টের অনুরোধ জানাতে হতো। এখন কেবল খেলাধুলার ধারাভাষ্যের জন্যই রেডিওগুলো কোনোমতে টিকে আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপে এফএম রেডিওর জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তা হলে কি হারিয়ে যাচ্ছে এফএম রেডিও? এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে অনেকেরই মুখে।
দেশে এফএম (ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন) রেডিওর সম্প্রচার এলাকার আয়তন এমনিতেই ছোট। তবে এফএম রেডিওর স্টেশনগুলো ছিল বেশ বড়সড়। প্রচুর কর্মীতে গমগম করত অফিস। হালে এফএম রেডিও স্টেশনগুলোর সব আয়তনই ছোট হয়েছে। ছোট হতে হতে কতগুলো স্টেশন বন্ধই হয়ে গেছে। অনেক স্টেশন গুটিয়ে ছোট করে ফেলা হয়েছে। বিজ্ঞাপন নেই, খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক স্টেশন কর্তৃপক্ষ রেডিও স্টেশনের আয়তন ছোট করে কোনোমতে রেডিওগুলো টিকিয়ে রেখেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে আগামী ৫ বছরের মধ্যে দেশে আরও কোনো এফএম রেডিও থাকবে না। এমনকি আগেও শেষ হয়ে যেতে পারে সাবেক জনপ্রিয় এই মাধ্যম।
এফএম রেডিওর জনপ্রিয়তা নেই কেন? এমন প্রশ্নে ঢাকা এফএম রেডিওতে কর্মরত আরজে মুকুল (মাহমুদুল আমীন মুকুল) জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোনো নতুনত্বের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি থাকে এটা স্বাভাবিক। বেসরকারিভাবে ২০০৬ সালে যখন এফএম রেডিওর যাত্রা শুরু হয়, তখন এর প্রতি মানুষের আগ্রহটা বেশি ছিল। এর আগে সরকারিভাবে বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচার হতো মেট্রো ওয়েব নামে রেডিও। বাংলাদেশ বেতারে যেভাবে শ্রোতা উপস্থাপনা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুনে আসছে এফএমে তার বিপরীত একটা বিষয় তারা অনুভব করে। এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, ওই সময়ে বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানি অ্যাড দিত যে তাদের মোবাইলে এফএম শোনা যায়।
আমি মনে করি এফএমের পতন হয় মূলত করোনার সময়ে। করোনার আগে এটা মোটমুটি ভালোভাবে চলছিল। করোনার সময়ে অনেক এফএম রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে যায়। আারজেরা ভয়ে সেখানে যেত না। অনেকে ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। তার আগে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এফএম একটা ভালো অবস্থানে ছিল। যখন ইউটিউব, ফেসবুকের প্রভাব বেড়ে গেল এফএমগুলো আস্তে আস্তে পড়ে গেল। আমি রেডিওতে বলা যায় শুরু থেকে কাজ করছি। এফএম পতনের পেছনে ইউটিউব, ফেসবুকের একটা অবদান আছে।
যখন আমরা কাজ শুরু করেছি, তখনো ফেসবুক, ইউটিউব ছিল কিন্তু সুলভ মূল্যে এত স্মার্ট ফোন ছিল না। যার কারণে লোকে ওইটাকে রিচ করতে পারত না। যখন দেখা গেল কম দামে স্মার্ট ফোন পাওয়া যাচ্ছে, তারা তখন সেই দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার কারণে এফএমের ওপর একটা ধাক্কা আসে।
তিনি বলেন, ফেসবুক, ইউটিউব, স্মার্ট ফোনের ধাক্কার পর, করোনার সময়ে এফএম পুরো অ্যাফেক্টেড হয়েছে। এ সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে কিন্তু এফএমের বড় ভূমিকা ছিল কিন্তু বাংলাদেশে বৈশ্বিক এই দুর্যোগের সময়ে এফএমের মালিকসহ অনেকে পিছিয়ে পড়েন। যার ফলে এফএমের জনপ্রিয়তা অনেক কমে যায়। করোনার সময়ে যদি এফএম রেডিওগুলো তথ্যবহুল কাজ করত মানুষ অনেক উপকৃত হতো। এর উল্টোটার কারণে মানুষ এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এটাও কিন্তু পতনের একটা কারণ। এ ছাড়া এফএমর পতনের ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের অনেক দায় আছে। বিশেষ করে মালিক পক্ষ। তারা দেখলেন করোনার সময়ে তাদের রেমিটেন্স কমে গেছে। তখন তারা পিছিয়ে পড়েন। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও সরকারি তেমন সাপোর্ট পায়নি এফএম রেডিও।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিগত দিনে এফএম রেডিওর অবাধ লাইসেন্স দেওয়াও কিন্তু পতনের একটা কারণ। সে সময়ে প্রায় ৩০টির মতো এফএম রেডিও হয়ে গিয়েছিল। সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রেমিটেন্সও কমে যায়। আমি মনে করি যুগ যুগ ধরে রেডিও কিন্তু একটা সুলভ গণমাধ্যম। এর লাইফ সার্কেল অনেক বড়। এটা কিন্তু বন্ধ হবে না। তবে আগের সেই জৌলুস ফিরে আসা কঠিন। যদি ম্যানেজমেন্ট স্ট্রং হয়, তবে রেডিও আগের জায়গায় ফিরে আসবে। আমরা রেডিওকে ফেসবুক বানিয়ে ফেলেছি। অনেক রেডিওতে ফেসবুক লাইভ হয়। রেডিও হচ্ছে শোনার মাধ্যম। রেডিওকে রেডিওর জায়গায় রাখতে হবে।
রেডিও আম্বারে কর্মরত আরজে মিনহাজ সিফাত বলেন, এফএম রেডিওর ধ্বসের পেছনে অনেক কারণ কয়েছে। এটা তো সামগ্রিক বিষয়। আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে বলি সেটা হচ্ছে, এফএম রেডিও প্রথমদিকে যখন আসে তখন মানুষের আগ্রহটা বেশি ছিল। সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। এটা বাড়তেই থাকবে। এফএম রেডিওর প্রচলনের শুরুতে হাতে হাতে এন্ড্রয়েড ফোন বা স্মার্ট ফোন এত বেশি ছিল না। যখন কনফেডারেশন বাড়ল তখন লিসেনার ভিউয়ারস আস্তে আস্তে ভাগ হওয়া শুরু করল।
কনফেডারেশনের কারণেও এফএম রেডিওর জনপ্রিয়তা এদিক ওদিক হয়ে গেছে। এ ছাড়া মানুষ এখন দেখতে পছন্দ করে। একটার পর একটা অপশন রান করছে। যার কারণে মানুষের চাহিদা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। রেডিও তো এককভাবে চলতে পারে না। এটাতে অনেক কলাকুশলী থাকে, অনেক ক্লাইন্ট থাকে। আমরা রেডিও থেকে যেমন সুস্থ বিনোদন দিতে চাই, ঠিক ক্লাইন্ট থেকে অথবা বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের পণ্যের ক্ষেত্রে পজিটিভ অ্যান্টিভিজিট থাকতে হয়। তারা হয়তো ভিউয়ের জন্য অথবা আরও বেশি লোকের কাছে পৌঁছার জন্য সেদিকে ট্রান্সফার করছে তাদের আইডিয়াগুলো। এফএম রেডিওর ক্ষেত্রে এটাও একটা ফ্যাক্ট মনে হয় আমার কাছে।
এফএম রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে মনে হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে সিফাত বলেন, আমি খুব ইতিবাচক চিন্তা করতে পছন্দ করি। আমার কাছে মনে হয় বাড়বে। এর কারণ হচ্ছে, আমি যে স্টেশনে আছি বা পাশাপাশি আরও যেসব স্টেশন আছে, একটা সময় ছিল আমরা শুধু শুনতাম। এখন কিন্তু বিষয়টি এখানে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন ডিজিটালে চলে আসছে। রেডিওগুলো সেম জিনিসটা করছে। অডিওর পাশাপাশি তারা ভিডিওতে বিভিন্ন কন্টেন্ট ক্রিয়েট করছে তাদের পেজ বা চ্যানেলের মাধ্যমে। এফএম রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণ হিসেবে আমি মনে করি, অনেক জায়গা আছে সেখানে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব বেশি অ্যাকটিভ না। রেডিওর আলাদা একটা ডিশেনরি আছে।
আমরা যদি মানসম্মত প্রোগ্রাম করতে পারি, বা তাদের ভাষা বুঝতে পারি, তা হলে রেডিওকে আবার আগের দিনে ফিরে আনা সম্ভব। এফএম রেডিওর ক্ষেত্রে করোনার সময় একটা স্থবির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে ধাক্কাটা আরও বেশি হয়। আমি মনে করি, ভালো ভালো অনুষ্ঠান মানুষ সব সময় বেশি শোনে। এগুলো দিতে পারলে আবার এফএমের সোনালি দিন ফিরে আসবে। দিন শেষে মানুষ পজিটিভের কাছে আসে। আমরা যদি পজিটিভ ওয়েতে সবাই একসঙ্গে মিলে কাজ করতে পারি, তা হলে অবশ্যই সুফল আসবে।
এফএম রেডিও সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা, এফএম রেডিওতে যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার হলেই তার ভাগ সরকারকে দিতে হয়। এমনিতেই এখন আয় নেই। ভাগ করতে গেলে আর কী থাকে। একটি রেডিও ঢাকা শহরে চালুর জন্য লাইসেন্স নিল। কিন্তু রেডিওটি যদি পরবর্তী সময়ে দেশের অন্য কোনো শহরে স্টেশন চালু করতে চায়, তা হলে সেখানকার জন্য ঢাকার শহরের সমান চার্জ, ট্যাক্স ও ভ্যাট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে দিতে হয়। এই জটিলতার জন্যও এই রেডিও সম্প্রসারণ করেও টিকতে পারেনি উদ্যোক্তারা।