উত্তর বাংলা ডেস্ক: ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে জীবন চালাতেও হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বৈষম্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের।
সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে এক বছর পূর্বে ২৬ নভেম্বর ২০২৩-এ ১ কেজি আলুর দাম ছিল ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। কয়েক মাস আগেও এক কেজি আলুর দাম ঘোরাফেরা করেছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। গতকাল ২৬ নভেম্বর ১ কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। এরই মধ্যে নতুন আলু বাজারে এসেছে তার দাম ১২০ টাকা কেজি। শুধু তাই নয় ভারত থেকে প্রতি কেজি আলু আমদানিতে খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। সেই আলুও খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা কেজিতে। এদিকে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নিম্ন মধ্য স্তরের মানুষকে স্বস্তি দিতে ৪০ টাকা কেজিতে (ট্রাক সেলের মাধ্যমে) আলু বিক্রি করছে সরকার। ১ কেজি আলু কিনতে সেই ট্রাকের পেছনে লম্বা লাইন পড়তে দেখা গেছে।
কেস স্টাডি : ১ স্কুলশিক্ষক শাহনাজ বেগম বলেন, তার স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা। মাসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। আগে প্রতি তিন মাসে একবার ঢাকার বাইরে বেড়াতে যেতেন। গত তিন বছরে কোথাও যেতে পারেননি। এমনকি আগে দুই ঈদে গ্রামের বাড়িতে যেতেন। খরচ সামলাতে না পেরে গত তিন বছরে তা কমিয়ে এক ঈদে যাচ্ছেন। দুজনের আয় দিয়েও টিকতে না পেরে এক বছর আগে পূর্বের বাসা ছেড়ে টাইলসবিহীন মোজাইক করা পুরনো বিল্ডিংয়ের নতুন বাসায় উঠেছেন। তাতে ২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া কমেছে। কিন্তু খাবার, ওষুধ, যাতায়াতের খরচ বাড়ায় জীবন চালাতে ত্রাহি অবস্থা। এ জন্য জানুয়ারি থেকে স্কুল ছুটির পর টিউশনি করাবেন ভাবছেন। টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে মোটা, চিকনসহ সব ধরনের চালের দামও বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাঝারি মানের চালের দাম। এক মাসের ব্যবধানে এই চালের দাম কেজিতে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে বাস্তবে বাজারে দাম আরও বেশি বেড়েছে। টিসিবির ওয়েবসাইটে মোটা চালের দাম সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা বলা হলেও এ চালের কেজি ৫৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। গত বোরো মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। ইতোমধ্যে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। সীমিত পরিসরে নতুন চাল বাজারে আসা শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের দাম কমার তেমন কোনো লক্ষণ নেই। তবে আটার দাম কিছুটা কমেছে গত তিন মাসের ব্যবধানে। টিসিবির তথ্যমতে, মুগ ও মসুর ডালের দামও বাড়তি। তবে মোটা দানার মসুর ডালের দাম এক মাসের ব্যবধানে কিছুটা কমেছে। যদিও মুগ, অ্যাংকর, ছোলার দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
এক বছরে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ৫১ টাকা আর মুগ ডালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে অন্তত ৪৩ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পিঁয়াজ, রসুন ও ভোজ্য তেলের বাড়তি দাম। প্রতি কেজি পিঁয়াজ এখনো ১১০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর রসুনের বাজারে তো রীতিমতো ঘোড়ার দৌড়ের গতি বিরাজ করছে। প্রতি কেজি রসুন গতকালও ২৩০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভোজ্য তেল হিসেবে সয়াবিন এবং পামওয়েলের দাম প্রতি লিটারে এক বছরে ৬ থেকে ১১ টাকা বেড়েছে। এদিকে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেছেন, এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। ধান উঠতে শুরু করেছে। ভরা মৌসুম শুরু হলে চালের বাজারে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে তিনি মনে করেন। অন্যদিকে ন্যায্যমূল্যে ধান চাল কিনতে সরকারও ইতোমধ্যে দাম কিছুটা বাড়িয়েছে। কেননা কৃষকের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় চার সদস্যের একটি পরিবারের প্রতি মাসে খাবারের পেছনে যে পরিমাণ ব্যয় হয়। সেটা এক বছরের আগের তুলনায় অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু আয় তো বাড়েনি।
কেস স্টাডি : ২ রোজিনা আক্তার নামের এক গৃহকর্মী বলেন, সারা মাসে দুজন মিলে যা আয় করি তার অর্ধেক চলে যায় ঘর ভাড়ার পেছনে। আর বাকিটা চলে যায় খাবার কিনতে। আগে তো দু-এক দিন পাঙাশ, তেলাপিয়া কিনতাম। এখন সবজি কিনতে ডর লাগে। কেননা সবজির বাজারও এখন মাছ মাংসের মতোই চড়া। সঙ্গে যোগ হয়েছে মরিচ, পিঁয়াজ ও তেল, লবণের বাড়তি দাম। এদিকে আলুসহ কৃষিপণ্যের দাম বাড়তি থাকলেও কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন অনেক বেশি। তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে এখন আলুর সরবরাহ সংকট রয়েছে।
আবার হিমাগার পর্যায়েও দাম বাড়ানো হয়েছে। এর পাশাপাশি বাজারে বিভিন্ন সবজি ও ডিমের দামে অস্থিতিশীলতাও আলুর দামে প্রভাব ফেলেছে। তবে দেশি ও আমদানিকৃত আলুর দাম কোনো অবস্থায়ই ৩৫ থেকে ৪০ টাকার বেশি হওয়ায় কথা নয়। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে এখন ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের কারসাজিকেও দায়ী করছেন অনেকে। বিশ্বব্যাংক ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সবার আগে জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। আমাদের বাজার ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। এখানে ঘাটে ঘাটে যে সিন্ডিকেট রয়েছে সেটার কারণে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও এবং আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কমালেও তার সুফল ভোক্তা সাধারণ পান না বলে তিনি মনে করেন।