আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫ ● ৪ ভাদ্র ১৪৩২
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫

বন্যা মোকাবেলায় করণীয়

শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২, দুপুর ১০:৩০

Advertisement Advertisement

মো.  শহিদুল ইসলাম 

বন্যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছরই দেশের প্রায় ৫০ ভাগ এলাকা বন্যার ফলে প্লাবিত হয়ে থাকে। ভৌগলিক অবস্থান,  ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদ-নদীসমূহের বিন্যাস, আন্তঃদেশীয় পানি বণ্টন সমস্যা, অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জলাভূমি ও জলাশয়সমূহ ভরাট, অপর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নেতিবাচকভাবে নদী শাসন, বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশের কোননা কোনো স্থান ছোট, মাঝারি বা বড় ধরনের বন্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তথ্যমতে গড়ে দশ থেকে পনের বছর পর বাংলাদেশে কমপক্ষে একটি বড় মাত্রার বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। সম্প্রতি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সংঘটিত বন্যার ভয়াবহতা উদ্বেগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্যা যেন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর বন্যায় ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, ফসল, পশু-প্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। দেশের সম্পদ ও মানুষকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হতে মুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে দেখতে হলে বন্যার মত দুর্যোগ মোকাবেলায় অবশ্যই আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।

দেশে সার্বিক বন্যা মোকাবেলা পদ্ধতিকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। সেগুলো হল; বন্যা পূর্বপ্রস্তুতি, বন্যাকালীন ও বন্যা পরবর্তী সময়ে করণীয়। বন্যা পূর্বপ্রস্তুতি বন্যা মোকাবেলায় খুবই ফলপ্রসূ। বন্যা পূর্ব প্রস্তুতি বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে;  যথাযথ বনায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বন্যার সঠিক পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ, জলাধার ও জলাশয়সমূহ পর্যাপ্তভাবে খনন ও রক্ষণাবেক্ষণ, বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি, আন্তঃদেশীয় পানি সমস্যা সমাধানে যথাযথ উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ, নদীর দুই পাড়ে সঠিক পদ্ধতিতে বাঁধ তৈরি, বন্যা প্রবণ অঞ্চলসমূহে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্যালাইন মজুদ রাখা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক কাপড় সংরক্ষণ করা, নৌকা বা ভেলা তৈরি করে রাখা, গবাদিপশু ও অন্যান্য প্রাণীদের জন্য উঁচু স্থানে মাঁচা তৈরি করা, সর্ব প্রকার ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা, বন্যা সহনীয় শস্যের চারা নির্বাচন ও রোপণ, জ্বালানী মজুদ করে রাখা, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা ইত্যাদি।

বন্যাকালীন সময়ে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের যত দ্রুত সম্ভব আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও নারীদের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। খাবার, পানি, ওষুধ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইত্যাদি ঘরের উঁচু স্থানে কিংবা সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে ফেলতে হবে। গবাদিপশু ও অন্যান্য প্রাণীদের উদ্ধার করে উঁচু স্থানে রাখতে হবে। বন্যার পানিতে নানারকম ক্ষতিকর পোকা-মাকড়, সাপ ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়, এছাড়াও বন্যার পানিতে গাছের ভাঙা ডাল, কাঁচের টুকরো, ব্লেড ইত্যাদি বস্তু থাকতে পারে সেজন্য সাবধানে চলাচল করতে হবে। বন্যার পানি পান ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সার্বক্ষণিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করতে হবে। বন্যা কবলিত এলাকায় অবস্থিত বাঁধ, স্লুইসগেট ইত্যাদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং যেকোন সমস্যা দেখা গেলে অতিদ্রুত পানি উন্নয়ন বোর্ড অথবা স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে। উদ্ধারকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ও মেডিকেল টিমকে সার্বক্ষণিকভাবে সক্রিয় ও তৎপর রাখতে হবে।  কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনমাফিক ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন হলে খাবার, পানি ইত্যাদি ভাগাভাগি করে খেতে হবে। ঘরে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রের আশেপাশে ক্ষতিকর পোকামাকড় হতে রক্ষা পেতে ওষুধ, কার্বলিক এসিড, কার্বলিক সাবানের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখতে হবে ইত্যাদি।

বন্যা পরবর্তী সময়ে করণীয় বিষয়গুলো হল; ঘর-বাড়ি, শৌচাগার ইত্যাদি স্বাস্থ্যসচেতনতার সাথে যেমন হ্যান্ডগ্লাভস ও জুতা পরিধান করে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। ফসলের ক্ষতি হলে নতুনভাবে ফসল জন্মানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত  রাস্তা-ঘাট, অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ করতে হবে। বসতবাড়ি এবং আশেপাশে কার্বলিক অ্যাসিড, কার্বলিক সাবান ও পোকামাকড় মারার ওষুধ ছিটিয়ে দিতে হবে।  বন্যা পরবর্তী সময়ে পশু-প্রাণীর মৃতদেহ ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ার কারণে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটে থাকে যা রোধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে বন্যা আক্রান্ত এলাকায় রোগব্যাধি বিশেষ করে কলেরা, ডায়রিয়া,  চর্মরোগ বেড়ে যায়, এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে মেডিকেল টিম গঠন করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার সংকট দেখা গেলে অন্যান্য উৎস হতে সাহায্য গ্রহণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে খাবার ভাগাভাগি করে খেতে হবে।

বাংলাদেশের মত দেশের ক্ষেত্রে বন্যা হয়তো একেবারেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না, তবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বন্যার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। বন্যা সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি অনেকটা আগে থেকেই বুঝতে পারা যায়, সেহেতু বন্যা মোকাবেলায় যাবতীয় কাঠামো ও অবকাঠামোগত বিষয়ে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা পূর্ব থেকেই সম্ভব। বর্তমান সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সেগুলোর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষদেরও বন্যা বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং বন্যা মোকাবেলায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।  সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং অংশগ্রহণ থাকলে বন্যার মত মারাত্মক জাতীয় দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হতে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব।  

লেখক: প্রভাষক (ভূগোল), রংপুর ক্যাডেট কলেজ, রংপুর ।

Email: sahidulislamges@gmail.com

মন্তব্য করুন


Link copied