অনলাইন ডেস্ক: ঢাকাসহ সারা দেশে অতিউৎসাহী নেতা-কর্মীদের কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বিএনপির। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চাঁদাবাজি ও দখল-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে থাকলেও কাউকে থামানো যাচ্ছে না। ক্ষমতায় চলে এসেছে এমন মনোভাব নিয়ে গত দুই মাসে বিভিন্ন স্থানে হামলা, চাঁদাবাজি, দখল, আবার কোথাও আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় সংঘর্ষসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন কিছু নেতা-কর্মী।
এমন পরিস্থিতিতে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, অতিউৎসাহী নেতা-কর্মীদের গত দুই মাসের কর্মকাণ্ড ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপির জন্য অনেক বড় অসুবিধা তৈরি করতে পারে। এসব কর্মকাণ্ড গত ১৬ বছরের জুলুম-নির্যাতন ও সরকারের মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার দলটিকে কিছুটা সমালোচনার মুখে ফেলেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। অনেকের মতে, এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
কারণ আগামী দিনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে কী ধরনের আচরণ করতে পারে, এসব ঘটনায় কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। তাই তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে এবং দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। সবশেষ ঢাকা-১০ আসনের প্রার্থী ও নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবির বিরুদ্ধে টিভি সাংবাদিক তানজিল জাহানকে হত্যার অভিযোগে তার দলীয় পদ স্থগিত করেছে বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপির ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণ্ন করছে তাদের আমরা কিন্তু ছাড় দিচ্ছি না। কেউ খারাপ কাজ করলে তার দায়ভার তো দল নেবে না। যেসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তারা ১৬ বছর আওয়ামী লীগের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তারপরও আমরা সেসব নেতা-কর্মীকে অব্যাহতি ও বহিষ্কার পর্যন্ত করছি। আমরা তো আর নেতা-কর্মীদের আইনের হাতে তুলে দিতে পারি না।’
দলীয় সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছে বিএনপি। এর পরও প্রতিনিয়ত অতিউৎসাহী নেতা-কর্মীদের দখল-চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ জমা পড়ছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। চাঁদাবাজি, দখল-বাণিজ্য এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২৪ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে ৫২৩ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ৪৩৭ জনকে বহিষ্কার, ২৪ জনের পদ স্থগিত, ৩৫ জনকে সতর্ক এবং ৪ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এত কম সময়ে এত বিপুলসংখ্যক নেতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা বিএনপিতে এই প্রথম বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
অবশ্য তারা এও বলছেন, অনেক ঘটনায় শীর্ষ নেতারা জড়িত না থাকলেও তাদের নামে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। মূলত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা অপকর্ম করছেন, আর দায়ভার নিতে হচ্ছে শীর্ষ নেতাদের।
অতিউৎসাহী নেতা-কর্মীদের কেন নির্দেশ দিয়েও থামানো যাচ্ছে না- এ প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাদের মধ্যে হয়তো বিএনপির গঠনতন্ত্র ও নীতির চর্চার অভাব রয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চাও নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাব ও গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারলে তো এমন ঘৃণ্য অপকর্মে জড়াতেন না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কিন্তু গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ ছিল মুদ্রার ওপিঠ। তাদের যে নেতা যত বেশি অপরাধ করেছেন তিনি তত বড় পদ পেয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদ সরকার ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে বিএনপির ওপর হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। ২০১৮ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা বলে আসছিলেন বিএনপি ক্ষমতায় এলে ১ লাখ মানুষ মারা যাবে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর গত ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সেই তুলনায় কিছু হয়েছে? হয়নি। বরং প্রশাসন না থাকায় বিএনপি সব জায়গায় পাহারা দিয়েছে।
ভাঙতে পারে মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কমিটি
দলীয় সূত্রমতে, দলে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এবং নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের শুরু থেকেই গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বিএনপি। নির্দেশনা অমান্যকারী দলের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী নেতা হয়েও ছাড় পাচ্ছেন না। নেওয়া হচ্ছে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা। যাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও বিলকিস জাহান, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ময়মনসিংহের বিএনপি নেতা ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে বহিষ্কারের পর দলের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ফুটপাতে চাঁদাবাজি, দখল-বাণিজ্য, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) প্রেসিডেন্ট করার আশ্বাসে চট্টগ্রামের বিতর্কিত ব্যবসায়ী তরফদার রুহুল আমিনের কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা নেওয়াসহ নানা অভিযোগে মাত্র আড়াই মাসে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্তি করা হয়। এবার একই অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কমিটিরও ভেঙে দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দপ্তরে জমা পড়েছে। শ্যামপুরে একটি লোহার ফ্যাক্টরি এবং সিএনজি স্টেশনে হামলা এবং লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ এক নেতার বিরুদ্ধে। এমনকি এই অভিযোগে সেনাবাহিনী বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছে ছাত্ররা। এ ছাড়া কাপ্তান বাজার, নবাবপুর, গুলিস্তান, কলাবাগান-কাঁঠালবাগান, শ্যামপুর, নিউ মার্কেট এলাকাসহ দক্ষিণের অনেক জায়গায় চাঁদাবাজি ও মার্কেট দখলসহ অনেক বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে।
তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু বলেন, ‘অভিযোগ পেলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ২০নং ওয়ার্ড কমিটি বাতিল করেছি। নিউ মার্কেট থানা বিএনপির নেতা জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করেছি। অনেককে শোকজ করা হয়েছে। মহানগর দক্ষিণ বিএনপি শৃঙ্খলার ব্যাপারে হার্ডলাইনে ছিল এবং থাকবে। তবে সব অভিযোগ সত্য নয়। মনোমালিন্য, দলীয় প্রতিযোগিতা, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নিয়েও অনেকে মিথ্যা অভিযোগ করেছে।’
অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এস এম শফিকুল আলম মনা, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমির এজাজ খান ও সদস্যসচিব মনিরুল হাসান বাপ্পি ও খুলনা সদর থানার সদস্যসচিব মো. মোল্লা ফরিদ- এই চারজনের নেতৃত্বে খুলনায় হামলা, চাঁদাবাজি ও দোকানপাট দখলের অভিযোগ রয়েছে। হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে তারা এখন অনেকটাই ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাবে চলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনা মহানগর বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, বিএনপির ছাত্রদল বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল ও তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালের হাত ধরেই তাদের উত্থান হয়েছে। কেন্দ্রীয় এই দুই নেতার ইন্ধনে তারা খুলনায় বাড়িঘর, পেট্রলপাম্প ও বাজারঘাট-দোকানপাট দখলসহ প্রতিটি জায়গায় চাঁদাবাজি ও দখল-বাণিজ্যের দুর্বৃত্তায়ন গড়ে তুলেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছেন তারা। সর্বশেষ হোরাজ ওষুধ মার্কেট দখল নিয়েছেন মহানগরের বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, আগের কমিটির লোকজন এসব রটাচ্ছেন। তারা বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলেছেন। কেন্দ্র তদন্ত করে দেখেছে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে তাদের বহিষ্কার করেছি।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতাদের বিরুদ্ধে এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম ওরফে নয়নের বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ গেলেও এখনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মূলত ২০১৮ সালের দলীয় এমপি প্রার্থীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের লোকজন এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় স্থানীয় বাজার, ব্রিজের টোলপ্লাজাসহ অনেক কিছুই বিএনপির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে এখন বেশ কিছু ঘটনায় শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ায় দলের সব স্তরে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘অতীতে কোনো দল এত বড় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত ১৬ বছরের জুলুম-নির্যাতনের শিকার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে হাইকমান্ড। কোনো অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘নব্য জাতীয়তাবাদী ও আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা তাদের পুরোনো ফ্যাসিবাদীদের দোসররা দলে ঢুকে অপকর্ম করছেন। বিএনপি মাল্টিপারপাস দল, এখানে নানা মতের-চিন্তার লোক রয়েছেন। তার পরও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে দ্রুতই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’