আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: কিশোরী গৃহকর্মীকে খুন্তির ছ্যাকা; রংপুর মেডিকেলে মৃত্যু যন্ত্রণায় পাঞ্জা লড়ছে নাজিরা       সারাদেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি       হিট অ্যালার্টে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি       শিল্পী সমিতির নতুন সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল       নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার      

 width=
 

দেবর-ভাবির ঐকমত্য কীসের ইঙ্গিত?

বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০২২, দুপুর ১০:১৮

সাইফুর রহমান তপন

জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ চিকিৎসা শেষে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় ফিরে যা করলেন, তাকে কি চমক বলা যায়?

ব্যাংককে তিনি গিয়েছিলেন চিকিৎসা-উত্তর চেকআপের জন্যে, গত ৪ জুলাই। সেখান থেকে অনেকটা হঠাৎ গত ৩০ আগস্ট তিনি রীতিমতো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা দেন, 'জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে' প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য জাতীয় পার্টিকে 'শক্তিশালী' করতে হবে। তাই দলের সম্মেলন করতে হবে। সম্মেলনের তারিখও ঘোষণা করেন তিনি- ২৬ নভেম্বর। কিন্তু ব্যাংকক থেকে দেশে ফিরলেন তিনি ২৭ নভেম্বর; কথিত সম্মেলনের নির্ধারিত সময়ের এক দিন পর!

শুধু কি তাই? হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের গরম খবরের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে তিনি ঘোষণা দেন, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে বসে 'ভুল বোঝাবুঝি'ও মিটিয়ে ফেলবেন এবং শুভস্য শীঘ্রম- সম্ভবত এ প্রবাদ মেনে ২৯ নভেম্বরই রওশন তাঁর ওয়েস্টিন হোটেল স্যুটে জি এম কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সকালের নাশতা সারেন। এর আগে রওশন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। সেটি হলো, আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জি এম কাদেরের সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী সেখানকার সদ্যবিদায়ী মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে দলের একক প্রার্থী হিসেবে মেনে নেন। বলা বাহুল্য, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে জি এম কাদের মোস্তফার দলীয় মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করতে পারেননি; স্বাক্ষর দিয়েছিলেন মহাসচিব। এ কারণে জোর গুঞ্জন ছিল, রওশন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিকল্প প্রার্থী দিলে মোস্তফার পক্ষে দলীয় লাঙ্গল প্রতীক পাওয়া কঠিন হবে। সব মিলিয়ে দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পাবে। কিন্তু মোস্তফাকে রওশনের সমর্থন সেই উত্তেজনাকেও থিতিয়ে দেয়।
রওশনের এসব তৎপরতাকে চমক বলা যায়, যদি ব্যাংককে অবস্থানকালীন তাঁর গত দুই মাসের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করা হয়। সেখানে বসে তিনি শুধু সম্মেলনের তারিখই ঘোষণা করেননি; দলের পুরো শীর্ষ কমিটি ভেঙে দিয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও গঠন করেন।

আবার জি এম কাদেরও রওশনপন্থি অনেক নেতাকে শুধু পদ নয়; দল থেকেও বহিস্কার করেন। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বটা আরও জমে ওঠে সংসদে জাপার চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে রওশনের পক্ষ নেওয়ায় পদ ও দল থেকে বহিস্কারের পর। রংপুরে মসিউর রহমান রাঙ্গা দীর্ঘ সময় মহানগর সভাপতি ছিলেন এবং সংসদ সদস্যও হয়েছেন একটি আসন থেকে। এ ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা হাতাহাতিও হয়।

জি এম কাদের এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি দলের সংসদীয় কমিটির সভা ডেকে 'সর্বসম্মতিক্রমে' রওশনকে বাদ দিয়ে নিজে বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে যান এবং এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য স্পিকারকে চাপও দেন। এমনকি এক পর্যায়ে চিঠি দেওয়ার দু'মাস পরও স্পিকার তাঁর সিদ্ধান্ত না জানালে জাপা সংসদ বয়কটেরও হুমকি দেয়।
বিষয়টি কিন্তু আসলেই সিরিয়াস ছিল। কারণ জাপার এমন সিদ্ধান্ত রীতিমতো রওশনের রুটি-রুজিতে আঘাত দেওয়া মতো ঘটনা। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা শুধু নয়; সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেন। এই যে মাসের পর মাস তিনি ব্যাংককে ছেলে, ছেলে-বউসহ কাটালেন, তা কঠিন হতো এ পদে না থাকলে।

তবে ব্যাংককে থাকতে এবং দেশে ফিরে রওশন এ পর্যন্ত যা করেছেন তাকে নাটকও বলা যেতে পারে। যখন অনেকেই মনে করছিলেন, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দলটি আবারও ভাঙনের মুখে পড়া প্রায় নিশ্চিত, তখনই দেবর-ভাবি জনসমক্ষে এমন আচরণ করলেন যেন দু'জনের মধ্যে কস্মিনকালেও কোনো দ্বন্দ্ব দূরস্থান, মতবিরোধও ছিল না। উভয়ের সর্বশেষ আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, কোনো এক শক্তির নির্দেশনায় তাঁরা যেন স্রেফ অভিনয় করে গেছেন।

চমক হোক আর নাটক; গত কয়েক মাসের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো- জাতীয় পার্টি এখনও 'স্বতন্ত্র' দল নয়। শাসকদের অঙ্গুলি হেলনেই তাকে চলতে হয়। দেবর-ভাবির আপাত বিরোধ যে শেষ হতে যাচ্ছে, তা সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন বয়কটের ঘোষণা দেওয়ার পরও সরকারের এক বায়বীয় আশ্বাসে জাপার তাতে যোগদানের মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছিল। সংসদে যোগদানের সময় জাপা মহাসচিব বলেছিলেন, সরকার তাঁদের বলেছে- জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা বানানো হবে। কিন্তু সংসদের অধিবেশন ইতোমধ্যে সমাপ্ত হওয়ার পরও সরকারের সে আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেছে। সর্বশেষ, জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াও এর প্রমাণ।

দেবর-ভাবি এর আগেও- এরশাদের মৃত্যুর পর জি এম কাদের নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন। তখন সম্প্রতি যাঁরা জি এম কাদেরের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই রওশনকে চেয়ারপারসন ঘোষণা করেছিলেন। জানা মতে, ওই সময়ও সরকার ত্রাতা হিসেবে জি এম কাদেরের পদ রক্ষা করেছিল।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে- এরশাদ না হয় মামলার ভয়ে ক্ষমতাসীনদের রায়ত হয়ে থেকেছিলেন। জি এম কাদেরের তো এমন কিছু নেই। একেবারে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তাঁর। তিনি কেন নিজেকে 'স্বাধীন' ঘোষণা করার পরও স্বাধীন হতে পারলেন না? আমার ধারণা, সমস্যা দলটার জন্মে। জাপার জন্ম হয়েছে সামরিক স্বৈরশাসনের গর্ভে অঢেল সুবিধা ভোগ করে, যা ছেড়ে জনগণের কাতারে নেমে আসা সহজ বিষয় নয়।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, সমকাল

মন্তব্য করুন


 

Link copied