আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ২২ অক্টোবর ২০২৪ ● ৭ কার্তিক ১৪৩১
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ২২ অক্টোবর ২০২৪
 
 width=
 
 
 width=
 
শিরোনাম: উত্তরবঙ্গে ঘনিয়ে আসছে শীত; তাপমাত্রা ১৭.৮       আড়াই শতাধিক এসআইকে অব্যাহতি       প্রবাসী সরকার: কী বলছে আ.লীগ ও ভারত       রংপুরে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল        ব্যারিস্টার সুমন আটক      

 width=
 

বিশ্ব পর্যটন দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ 

মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, সকাল ০৮:৪০

শেখ মাজেদুল হক

প্রতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এ দিবসের লক্ষ্য। চলতি বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো-‘পর্যটনে নতুন ভাবনা’।

পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। কি নেই আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে! আমাদের আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অপরূপ লীলাভূমি সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, পাহাড়। এছাড়াও, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যেমন অসংখ্য নদ নদী, তেমনি আছে অসংখ্য হাওর-বাঁওড় খাল-বিল। এক দশক আগেও বাংলাদেশের পর্যটন সম্পদগুলো মানুষের কাছে অজানা ছিল।বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর আয়তনের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হলেও পেয়েছিল এক বিচিত্র সংস্কৃতি। বিচিত্র সংস্কৃতি দিয়েই ধীরে ধীরে পৃথিবীতে জানান দিয়েছিল নিজের অস্তিত্বের, বাঙালি জাতিসত্তার এবং আমাদের সোনার বাংলার। বারো মাসে তের পার্বণ উদযাপন করা বাঙালির জীবনে সংস্কৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশে সমতল ভূমি, পাহাড়, নদ-নদী এসবকে ঘিরে ঘড়ে উঠেছে নতুন জাতি, উপজাতি যাদের ভাষা, আচার আচরণ, ধর্ম, বর্ণ, খাবারে রয়েছে নিজস্বতা ও বিচিত্রতা।

সংস্কৃতি বলতে সাধারণ অর্থে মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণ, ব্যবহার, ধর্ম, জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিক কার্যক্রম কে বোঝায়। রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিচিত্রতা নিয়ে আসে সংস্কৃতি। সকল দেশের মানুষই তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চায় বিশ্বের পর্দায়। তাদের উৎসব উদযাপনে আমন্ত্রণ জানায় অন্যদের, নিজেদের বৈচিত্র্যতার মাধ্যমে জানান দিতে চায় পুরো বিশ্বকে। আদিম যুগ থেকে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে, বাণিজ্যের জন্য অথবা নতুন স্থান অনুসন্ধানে। তখন থেকে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের শুরু। মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। নতুন কোনো স্থানে, দেশে ভ্রমণ করতে সবসময় পছন্দ করে। সাধারণভাবে, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম বলতে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়-পর্বত, জঙ্গল পাড়ি দেয়া, অজানাকে জানার চেষ্টা করা, নতুন পথ খোঁজাকে বোঝায়। হাইকিং, বাইকিং, মাউন্টেনিয়ারিং, ট্র্যাকিং, স্কাই ডাইভিং, সার্ফিং, জিপলাইনিং, রাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং, সমুদ্রে সাতার কাটা, সমুদ্র তলদেশ দেখা ইত্যাদি সবই অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের অন্তর্ভুক্ত। এই ট্যুরিজমকে অন্যভাবে রোমাঞ্চকর পর্যটনও বলা হয়ে থাকে।

পাহাড়, সমুদ্র, নদী, ঝর্ণা ও রূপ লাবণ্যে ভরা দেশ বাংলাদেশ। ভ্রমণ পিপাসু তরুণ প্রজন্ম সবসময় এগুলো দেখা, নতুন নতুন ঝর্ণা সন্ধান করা, পাহাড়-চূড়ায় পাড়ি দেওয়ার জন্য কৌতূহলী হয়ে থাকে। সুন্দরবন, সিলেট ও তিন পার্বত্য জেলাতে মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সম্ভাবনা বেশি। দিন দিন এই ট্যুরিজমের চাহিদা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেশের ভেতরে ভ্রমণকারী মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ তরুণ। আর তরুণরা সবসময়ই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হয়। কেউ সাগরে সাঁতার কাটতে চায়, কেউবা পাহাড়ে ভ্রমণ করতে যান, আবার কেউবা গুহা, বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। সুতরাং এটা সহজেই বলা যায় যে, আগামীতে বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। আমাদের এই দেশ মাতৃকা বাংলাদেশ অপার সৌন্দর্য আর সম্পদের ভাণ্ডার। এ বাংলার বুকে অলংকারের ন্যায় সজ্জিত আঁকাবাঁকা নকশি আঁকা নদী। এসব নদী বাঙালীর জীবন আর প্রাণের উৎস, যা কিনা বাঙালির দেহে জুগিয়েছে প্রাণ। তাই নদীর ঠাই হয়েছে পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের মতো অনেক কবি সাহিত্যিকের রচনায়। কৃষি সেচ, আমিষের উৎস থেকে শুরু করে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমও এই নদী। নদী যেন সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভালোবাসার অলংকার।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য জানা অজানা পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান, যেগুলো যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ করছে হাজারও পর্যটককে। তাই ইতিহাসের পাতায় ও বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের বর্ণনায় বার বার উঠে এসেছে বাংলার সৌন্দর্য আর প্রাণ-প্রকৃতির কথা। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের ভ্রমণ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এবং ভ্রমণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদানের কারণে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি পর্যটন খাত। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ছয় ঋতুর প্রকৃতির খেলা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্যকে ঘিরেও রয়েছে পর্যটনের এক বিশাল সম্ভাবনাময় ভাণ্ডার।তুলনামূলক ভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটক আকর্ষণে যে বৈচিত্র্য, তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের পর্যটন বিকাশের সুযোগ রয়েছে। যার মাঝে ইকো ট্যুরিজম, আর্কিওলজিক্যাল ট্যুরিজম, রিলিজিয়াস ট্যুরিজম এবং বিচ ট্যুরিজম এখন অনেকটাই সমৃদ্ধ।

২০১৪ সালে বিশ্বের যে ২০টি দেশ পর্যটন খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি করবে, তার একটি বাংলাদেশ। এ ছাড়া আগামী এক দশকে পর্যটন খাতে যে ১২টি দেশ দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি করবে, সেখানেও আছে বাংলাদেশ।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) এ বছরের প্রতিবেদনে এই আশাবাদের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এই সংস্থাটি বিশ্বের ১৮৪টি দেশের পর্যটন নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এর আগে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান লোনলি প্ল্যানেট বলেছিল, বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য পৃথিবীর সেরা দেশ হতে পারে বাংলাদেশ।

পর্যটন খাত নিয়ে এমন সম্ভাবনার পাশাপাশি হতাশার দিকও আছে। পর্যটন সক্ষমতা-সংক্রান্ত ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩। ২০১২ সালে ১৪৪টি দেশের মধ্যে ১১৮ এবং ২০১১ সালে ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯।অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা, পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক প্রচার নেই বলে সম্ভাবনাময় এই খাতটি পিছিয়ে আছে। পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বিশ্বের ৭০টি দেশের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে আসতে ‘অন-অ্যারাইভাল ভিসা’-সুবিধা আছে। কিন্তু পর্যটন নিয়ে কোনো প্রচার নেই। ফলে এসব দেশের নাগরিকেরা এ দেশে আসছেন না। আবার সড়ক যোগাযোগব্যবস্থাসহ নানা সমস্যার কারণে দেশের সচ্ছল মানুষও ঘুরতে চলে যাচ্ছেন বিদেশে।মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত—এই দেশগুলো পর্যটক আনার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়েছে, বিনিয়োগ করেছে। এখন তারা এর সুফল পাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত বা ম্যানগ্রোভ বন থাকার পরও আমরা সেটি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারছি না।’

টুর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুধু মালয়েশিয়াতেই বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৩৫ হাজার পর্যটক গেছেন। থাইল্যান্ডে গেছেন ৮৫ হাজার। ভারতে যাচ্ছেন প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় লাখ। ৩০ থেকে ৪০ হাজার যাচ্ছেন সিঙ্গাপুরে। এ ছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কায় ভিসা লাগে না বলে সেখানেও যাচ্ছেন বিপুল পর্যটক। তার পরও দেশের ভেতরে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। এর একটি বড় অংশই অবশ্য তরুণ।

কোনো কিছু করার আগে আগাম পরিকল্পনা অবশ্যই দরকার। বাংলাদেশে কোন জেলায় কি কি পর্যটনের সম্ভাবনা ও চাহিদা রয়েছে তা বিবেচনা করে পর্যটন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে পরিকল্পনা গ্রহণ করার এখনই যুক্তিযুক্ত সময়। যে কোনো পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামোগত সুবিধা যেমন: আবাসন সুবিধা, যাতায়াত সুবিধা এবং নিরাপত্তা প্রধান বিষয় গুলোর মধ্যে অন্যতম। পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করে এ পর্যটন ধারাকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ ও পরিকল্পনা। প্রচার প্রচারণার অভাবে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমসহ দেশের পর্যটন স্থানগুলো সম্পর্কে বিদেশি পর্যটকরা জানতে পারেনা। ফলে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছি না।

বিদেশী টিভি চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে দেশের সকল পর্যটন কেন্দ্রকে উপস্থাপন ও তুলে ধরে, দেশী ও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা যেতে পারে। পর্যটন শিল্প বর্তমান বিশ্বে শ্রমঘন এবং সর্ববৃহৎ শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নসহ দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য পর্যটনের গুরুত্ব অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশে পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান,  মার্কেটিং বিভাগ।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।
smh.mkt@brur.ac.bd 

 

 

মন্তব্য করুন


 

Link copied