আর্কাইভ  শনিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৪ ● ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: রংপুরে ১২ মামলায় গ্রেপ্তার ১৭৫       আহতরা যেই দলেরই হোক, চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার: প্রধানমন্ত্রী       ২৭শে জুলাই রংপুর বিভাগের আট জেলায় কারফিউ শিথিল       সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান বেরোবি প্রশাসনের       "শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে"      

 width=
 

তীব্র দাবদাহে পুড়ছে রংপুর, জনজীবনে বাড়ছে হাঁসফাঁস

রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০২৪, বিকাল ০৭:৪৭

মমিনুল ইসলাম রিপন: বাংলা বৈশাখ মাস শুরুর সপ্তাহ পার। তবুও আকাশে কালো মেঘের ডাকাডাকি নেই। নেই বৈশাখী ঝড়ের ঘনঘটা অন্ধকার প্রকৃতি। বরং তপ্ত রোদ আর অসহ্য তাপমাত্রায় জনজীবনে বাড়ছে হাঁসফাঁস। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির বিরূপ আচরণই জানিয়ে দিচ্ছে ঋতুচক্র বর্ষপুঞ্জিতে আটকা পড়েছে। কালবৈশাখী ঝড়ের ভয়ের চেয়ে এখন ভয় বাড়াচ্ছে অব্যাহত গরম। দিনে দিনে এ তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।

দেশের অন্যান্য জায়গার মতো উত্তরের বিভাগীয় জেলা রংপুরও পুড়ছে মৃদু তাপপ্রবাহে। সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে লোডশেডিং। অসহনীয় গরম আর তাপদাহে বিমূর্ষ প্রাণ-প্রকৃতি। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এমন গরমে মানুষসহ হাঁসফাঁস করছে পশু-পাখিও। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না অনেকেই। সবমিলিয়ে রংপুর নগরীসহ জেলার সর্বত্র গরমে বেড়েছে অস্বস্তির মাত্রা। এখন এক পশলার বৃষ্টির অপেক্ষায় এই জনপদের মানুষ।

এদিকে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে রংপুরে বেড়ে চলেছে হিট স্ট্রোক, জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা তাপপ্রবাহে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে নিম্নআয়ের মানুষরা পড়েছেন বিপাকে। সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই কাজে যাচ্ছেন তারা। অনেকেই আবার গরম সইতে না পেরে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন।

বিভাগের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা কেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দিসহ মৌসুমী রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। 

তাছাড়া প্রতিদিনই কম-বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তীব্র গরমের কারণে নিম্নআয়ের দিনমজুর, শ্রমিক, ক্ষেত মজুররা হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা। তিন আগে রমেক হাসপাতালে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।

রমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় নামের এক যুবকের সঙ্গে। প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবাকে হাসপাতালে এসেছেন তিনি। এই যুবক বলেন, প্রচণ্ড রোদে তার বাবার শরীরে জ্বর এসেছে। সঙ্গে সর্দি, কাশিও আছে। জ্বর না কমায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।

জরুরি বিভাগে থাকা কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলছেন, প্রচণ্ড রোদের কারণে এমনটি হয়েছে। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে জ্বর লক্ষ্য করা গেছে।তীব্র দাবপ্রবাহের কারণে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষজন জ্বর, সর্দি, কাশিসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এজন্য ডাবসহ তরল জাতীয় ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভ্যাপসা গরমে অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন কর্মজীবী মানুষজন। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তাপদাহ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বেড়েছে ঠান্ডা পানীয়র। চলতি পথে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লেবু ও ফলের শরবত খেয়ে শরীর জুড়িয়ে নিচ্ছেন অনেকে। চাহিদা বেড়েছে ডাবের পানির, বিক্রি হচ্ছে তরমুজও। তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন দাবদাহের কারণে রংপুর নগরীর সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। বড় বড় শপিংমল, বিপণী বিতান ও মার্কেটগুলো খোলা থাকলেও নেই ক্রেতাদের সোরগোল। অলস সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন পরিবহনের চালক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ কর্মজীবী মানুষরা গরম উপেক্ষা করে বের হলেও অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন।

নগরীর শাপলা চত্বরে কথা হয় রিকশাচালক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। মাথার ওপর ছাতা থাকার পরও গরমের চোটে হাঁপিয়ে ওঠা এই রিকশাচালক বলেন, গরমে বাড়ির বাইরোত ব্যারে মনে হওছে জানটা চলি যাইবে। এতো ক্যানে গরম বাহে? ঘরোত থাকাও দায়। ফ্যানের বাতাসও গরম নাগে। শরীর থাকি খালি ঘাম ঝরোছে। রোইদোত বাইরোত রিকস্যা নিয়্যা ব্যারেয়া মোর অবস্থা তো খারাপ। কিন্তু কোনো উপায় নাই গাড়ি না চালাইলে খামো কি?

ব্যটারীচালিত থ্রি-হুইলার অটোচালক আন্দেশ মিয়া বলেন, ভ্যাপসা গরমের কারণে অটো চালানো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না। এত গরম যে, বসার সিট পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। রোদের কারণে রাস্তায় টেকাই যাচ্ছে না। মানুষজনও কম বের হচ্ছে। এভাবে গরম অব্যাহত থাকলে আমাদের মতো গরীব মানুষের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়বে।

নগরীর জাহাজ কোম্পানীর মোড়ে কথা হয় শরিফুল ইসলাম নামে একজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে। তিনি বলেন, দুইদিন থেকে বাড়িতে বাচ্চাসহ তিনজন অসুস্থ। প্রচণ্ড রোদ ও গরমে জ্বর ও ব্যথায় সবাই কাবু। প্রাথমিক চিকিৎসা করেও জ্বর সর্দি কমছে না। এ কারণে ওষুধ নিতে বাধ্য হলাম।

বিদ্যুৎ গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তীব্র দাবদাহ থাকে। আবার দিনে ও রাতে বেশির ভাগ সময় থাকে না বিদ্যুৎ। এতে জনজীবনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আব্দুর রহমান নামে একজন বেসরকারি কর্মকর্তা বলেন, গরমের সঙ্গে লোডশেডিংয়ে বাসার শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। দিনে তো বিদ্যুৎ থাকেই না রাতেও থাকে না।

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ আলী বলেন, গত কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৪-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠা নামা করছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়াই ভালো। বিশেষ করে এই সময়ে শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের আরও সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি বেশি করে তরল জাতীয় শরবত, ডাবেরপানি পান করা উচিত।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীসহ জ্বর, সর্দি ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত তিনদিনে অন্তত ৩০ জন রোগী হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, গরমে অনেকেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এ সময় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। বেশি করে পানি পান, ঠাণ্ডা জাতীয় পানীয় বিশেষ করে লেবুর শরবত, ডাবের পানি বেশি করে পান করতে হবে।

এদিকে আবহাওয়া অফিস দুঃসংবাদ দিয়ে বলছে, রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে। একই সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ ও সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, রোববার (২১ এপ্রিল) বিকেল ৩টা পর্যন্ত রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের দিন শনিবার (২০ এপ্রিল) তা ছিল ৩২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত কয়েকদিন ধরে রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ওঠা নামা করছে।

তিনি আরও বলেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। গতবছরে রংপুর অঞ্চলে ১৯৮১ সালের পর চলতি মাসের ১ জুন আবহাওয়া অফিস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আগামী এক সপ্তাহ এমন তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি বিরাজ করবে। এরমধ্যে বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনা নেই। 

মন্তব্য করুন


 

Link copied